ভূমিকা
দত্তা শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের মধুর তম প্রেমের উপন্যাস, বিশ্বের মধুরতম প্রেমের উপন্যাস গুলোর একটি -পৃথিবীর সব প্রেমের উপন্যাস না পড়ে বলা যায় সুন্দরকে উপলব্ধি করার জন্যে মহাজগতে সব সৌন্দর্য চোখে দেখে আসার দরকার করেনা। মনে পড়েছে, সাইত্রিশ বছর আগে, একটি পনেরো বছরের বালক প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে হঠাৎ হাতে পেয়েছিলো দত্তা, এবং সে পড়ে গিয়েছিলো মধুর প্লাবনের মধ্যে, প্রায় পনেরো দিন সে যাপন করেছিল ওই প্লাবনে, বারবার পড়েছিলো উপন্যাসটি , বারো বারের মতো। এর আগে সে এতো আলোড়ন আগে কখনো বোধ করেনি। তখন সে অনবিজ্ঞ নিষ্পাপ ছিলো, বিশ্বের কোনো মহৎ সাহিত্যের সাথে তার পরিচয় ঘটেনি। পরিচয় ঘটেনি বিশ্বের সাথেই, তারপর সে বিশ্বকে জেনেছে, ভরে উঠেছে অভিজ্ঞতা ও পঙ্কে, গেছে দুরূহ জটিল শিল্পকলার ভেতর দিয়ে ,বিশ্ব সাহিত্য তার অজানা থাকেনি, এবং নিজেও সৃষ্টি করেছেন এমন কিছু, যাকে বলা যায় সাহিত্য। প্রায় চার দশক পর আবার দত্তা পড়তে গিয়ে সে ভয় পাচ্ছিল , হয়তো তার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে টুকরো টুকরো হয়ে ,কিন্তু সে সুখী বোধ করে চার দশক আগে যে মধুস্রোতে পড়েছিল সে , আবার সেই মধুই পান করে অবিরল । শরৎনিন্দা একটি দুটি দশক এসেছিল বিশশতকের মধ্যভাগে ,বহু ক্ষুদ্রকে বড় করে তোলা হয়েছিল , তার অশেষ জনপ্রিয়তাকে দোষ গন্য করে মেতে উঠেছিলেন মাঝারি মাপের সমালোচকরা। শরৎচন্দ্র পাঁচ পয়সার জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না। ছিলেন গুরুত্বপূর্ন ঔপন্যাসিক, এবং জনপ্রিয়। তিনি যেমন খুলে দিয়েছিলেন বাঙালির আবেগ ও ভাবাবেগের দরোজাটি, তেমনি মেলে ধরেছিলেন বিপুল বাস্তব অভিজ্ঞতার বিশ্ব,যা আজকের লেখকদের নেই। তিনি শুধু খুশি করে চলেননি কাহিনীভোজীদের , তাদের বিচলিত পীড়িত করেছেন, তাদের বহু বহু ভিত্তি টলিয়ে দিয়েছেন। তিনি যেমন লিখেছেন করুনবিষাদময় অকতুলনীয় ভাবাবেগের দেবদাস,তেমনি লিখেছেন পীড়দায়ক প্রেমের গৃহদাহ এবং লিখেছেন কোমল মধুর হৃদয় ভরানো প্রেমের দত্তা।কর্কশ লেখক ছিলেন না শরৎচন্দ্র ,আর হৃদয়াবগ যখন তাঁর বিষয়। তখন তিনি কোমল হয়ে উঠতে পারতেন শিশিরের মতো। দত্তা্য় তিনি মধুরতা ছড়িয়েছেন প্রেমের ,তবে ঐ প্রেম অতো অম্লান মধুর হতো না যদি না তা মুখোমুখি হতো তীব্র প্রতিপক্ষের ;শরৎচন্দ্র , গল্পের রাজা , উপন্যাস জুড়ে মরুভূমির মতো বিস্তৃত করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে, প্রতিপক্ষের সুপরিকল্পিত চক্রান্তকে এবং তার ওপর ফুটিয়েছেন রক্তগোলাপ। বিয়ের মধ্য দিয়ে সাধারণত শেষ হয় বাজে উপন্যাস, কিন্তু দত্তা এর ব্যতিক্রম; পাঠক জানতো না তরুনীও জানতো না যে বিয়ে হতে যাচ্ছে তাঁর প্রিয়রই সাথে , আকস্মিক অভাবিতভাবেই ঘটে ঘটনাটি, এবং আমরা সুথী হয়ে উঠি ,ভরে উঠি শুভময়তায়। জীবনে যেখানে সুখ ও শুভ অত্যন্ত অচেনা হয়ে গেছে , সেখানে এমন একটি ঘটনা ঘটতে ধেখে আর প্রশ্ন করি না -এটা শিল্পকলা হলো কি না, শুধু মন বলতে থাকে সুখী হয়েছি- আমি আনন্দিত ।
দত্তার কাহিনী, শরৎচন্দ্র বলেছেন,‘দু’মাস-ছ’মাসের কথা নয়, পঁচিশ বৎসরের কাহিনী বলিতেছি, জগদীশ বনমালী রাসবিহারী বাল্যকাল ধরলে কাহিনী পঞ্চাশেরও বেশি বছরের,কিন্তু মূল কাহিনী মাত্র আট মাসের -শরতের এক প্রভাতে যেদিন তরুনী ব্রাহ্ম জমিদার বিজয়া হুগলি স্টেশন থেকে খোলা ফিটনে চড়ে মাতাপিতামহের পল্লীর বাড়িতে আসে, সেদিন থেকে বোশেখের মাঝামাঝি পর্যন্ত-এর মাঝে তার জীবনের প্রেস আসে শরতের জ্যোৎস্নার মতো নীরবে নিঃশব্দে, এবং তাঁর জীবনটা আকস্মিক বদলে হয়ে ওঠে জীবন।