“শ্রীকান্ত” বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
একদিক দিয়া দেখিতে গেলে শ্রীকান্ত (১ম পর্ব-১৯১৭; ২য় পর্ব-১৯১৮; ৩য় পর্ব-১৯২৭; ৪র্থ পর্ব-১৯৩৩) শরৎচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ইহাকে ঠিক উপন্যাস বলা চলে কিনা, তাহা একটু বিবেচনার বিষয়। উপন্যাসের নিবিড়, অবিচ্ছিন্ন ঐক্য ইহার নাই; ইহা কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পরিচ্ছেদের সমষ্টি। কিন্তু ইহার গ্রন্থন-সূত্রটা যতই শিথিল হউক না কেন, গ্রথিত পরিচ্ছেদগুলি এক-একটি মহামূল্য রত্ন। যাহাদের জীবন চিরদিন একটা অভ্যস্ত গণ্ডির মধ্যে কাটিয়াছে, যাহারা জীবিকার্জনের ও সংসার-প্রতিপালনের প্রচন্ড নেশায় অনেকটা অর্ধচেতনভাবে জীবনটা অতিবাহিত করিয়াছে, তাহারা শ্রীকান্ত’-এর দৃশ্যগুলির অসাধারণ বৈচিত্র্যে ও অভিনবত্বে একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িবে। আমাদের স্কুল-কলেজ-অফিসের লৌহনিগড়-বদ্ধ, রােগ-শােক-জর্জরিত, দলাদলি-বিরােধ-কন্যাদায়-বিড়ম্বিত বাঙালি-জীবনের প্রান্তসীমায় যে বিচিত্র রসভভাগের এত প্রচুর অবসর আছে, দুঃসাহসিকতার এত ব্যাকুল, প্রবল আকর্ষণ আছে, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও সমালােচনার এরূপ বিশাল, অব্যবহৃত ক্ষেত্র পড়িয়া আছে, চক্ষুর ও হৃদয়ের এত অপর্যাপ্ত রসদ মজুত আছে তাহা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। এই কল্পনাতীত বিচিত্র সৌন্দর্য ‘শ্রীকান্ত আমাদের মুগ্ধ নয়নের সম্মুখে আনিয়া ধরিয়াছে ও মুক্তহস্তে আমাদের পাতে পরিবেশন করিয়াছে। শ্রীকান্তের ভাগ্যে যে সমস্ত বিচিত্র, বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা লাভ হইয়াছে তাহা শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসে মানসিক উদারতা ও সূক্ষ্ম নীতিজ্ঞানের মূল; যে আলােক তাঁহার অন্যান্য উপন্যাসে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ‘শ্রীকান্ত’-এই তাহার আদি উৎস।