“মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ” বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
‘মাওলার অভিষেক’ এবং ‘ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণ’ এই বই দুইটি একত্রিত করিয়া পুনর্মুদ্রণ করা হইল। বইটির নামকরণে স্বাভাবিকভাবেই তাই পরিবর্তন আনা হইল। গাদিরে খুমের ঘটনা এমন একটি ঘটনা, ধর্মীয় ইতিহাসে যাহার গুরুত্ব ব্যাখ্যার কোন অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্র পরিচালকগণ ইহার গুরুত্ব সম্যক অবগত ছিলেন বলিয়াই সেখানে আগত অহি-বাক্য দুইটি একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থান লাভ করিতে পারে নাই। ফলতঃ প্রথম বাক্যটি হইতে মাওলার নাম বাদ দেওয়া হইয়াছে এবং শেষ বাক্যটি অন্যত্র অপ্রাসঙ্গিক একটি বড় বাক্যের মধ্যে আত্মগােপন করিয়াছে। উহা স্বতন্ত্র একটি ‘আয়াতরূপ’ অবস্থান লাভ করিতেও পারে নাই। এইরূপে গাদিরে খুমের অভিষেক ক্রিয়ার উল্লেখ কোরান হইতে এক প্রকার মুছিয়াই গিয়াছে। পরবর্তী রাষ্ট্রীয় প্রচার চক্রান্ত তথা উমাইয়া এবং আব্বাসীয় চক্রান্ত এই বিষয়টির উল্লেখ সমাজের বৃহত্তম অংশের স্মৃতি হইতে মুছিয়া ফেলিতে সক্ষম হইয়াছে, যদিও তাহা একেবারে মুছিয়া ফেলা সম্ভবপর হয় নাই।
হাদিসে রসুল এবং ইতিহাস আজও তাহার সাক্ষ্য বহন করিয়া আসিতেছে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় বিবাদ এবং রাষ্ট্রীয় বিবাদের মূল উৎসমুখ হইল ঐতিহাসিক এই অভিষেক ক্রিয়া। ইহা অমান্য করিবার পর হইতে মুসলমানের ধর্মমত ও পথ বিভ্রান্তির শত ধারায় বিভক্ত হইতে লাগিল। অতএব আরব জাতির ইতিহাস এবং আমাদের ইসলাম ধর্মের বিবর্তনের মূলসূত্ৰ সন্ধান করিতে গেলেই মনের। মধ্যে জাগিয়া উঠিবে গাদিরে খুম। কোরানের অবতীর্ণ বাণীর সর্বশেষ বাক্য দুইটি গাদিরে খুমে নাজেল হইয়াছিল। তাহা ছিল নিম্নরূপ : (৫:৬৭) হে রসুল, আপনার রব হইতে আপনার দিকে যাহা নাজেল করা হইয়াছে তাহা পৌছাইয়া দিন-তাহা এই যে, আলী মােমিনগণের মাওলা আর যদি তাহা না করেন তাহা হইলে তাঁহার (আল্লাহর) রেসালত পৌছাইয়া দেওয়া হইল না। আল্লাহ আপনাকে মানবমণ্ডলী হইতে লইয়া আসিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের কওমকে হেদায়েত করেন না। (তৃতীয় পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)।
উক্ত নির্দেশ অনুযায়ী অভিষেক ক্রিয়া সেখানেই সম্পন্ন করা হইলে পর কোরানের শেষ আয়াত নাজেল হইল (যাহা ৫:৩ এর মধ্যখানে বসান হইয়াছে) : ২। আজ কাফেরগণ তােমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তােমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তােমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তােমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম। (৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায়) আল্লাহ্ হইতে অবতীর্ণ এই সর্বশেষ আয়াতটিকে যে আয়াতের মধ্যবর্তী একটি অংশ হিসাবে স্থান দেওয়া হইয়াছে সেই আয়াতটির সম্পূর্ণ অনুবাদ নিম্নরূপ (৫:৩) : তােমাদের জন্য (খাদ্য হিসাবে) হারাম করা হইয়াছে শব এবং রক্ত এবং শূকরের মাংস এবং যাহা আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে উৎসর্গিত হইয়াছে এবং গলা চাপিয়া মারা (জন্তু) এবং প্রহারে মৃত (জন্তু) শৃংগাঘাতে মৃত (জন্তু) এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া (জন্তু)-তবে জবেহ দ্বারা যাহা পবিত্র করিয়াছ তাহা ব্যতীত এবং যাহা (মূর্তিপূজার) বেদীর উপর জবাই দেওয়া হয় এবং জুয়ার তীর দ্বারা অংশ নির্ণয়কৃত মাংস। এই সবই ফাসেকী।
আজ কাফেরগণ তােমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তােমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তােমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তােমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম। সুতরাং যে ব্যক্তি, পাপের দিকে ঝুঁকিয়া নহে, ক্ষুধায় কাতর-তাহা হইলে নিশ্চয় আল্লাহ (তাহার প্রতি) ক্ষমাশীল রহিম। কোরানের শেষ অবতীর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ এই অহি বাক্যটি যাহা গাদিরে খুমে অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা এমন জায়গায় স্থাপন করা হইয়াছে। বলিলেই চলে। ধর্মের নামে যেসব বিধান চলিতেছে তাহা আসলে আল্লাহর নামে রাজকীয় ধর্ম’। মূর্তিপূজা পরিত্যক্ত হইয়াছিল বটে কিন্তু মানুষ স্বাধীন হইতে পারে নাই। মানুষ আল্লাহর দাস না হইয়া অবশেষে আরব সাম্রাজ্যবাদের দাসে পরিণত হইয়াছিল।
আরব জাতি রসুলের আনীত মুক্তির বাণী ব্যর্থ করিয়া দিল। রাজ্য জয়ের মধ্যে ইসলামের জয় ছিল না। যদিও মােহাম্মদী ইসলামের জন্ম মক্কায়, কিন্তু সেখান হইতে লাঞ্ছিতবিতাড়িত হইল। মদিনায় আশ্রিত হইয়া অতিকষ্টে বড় হইল। উমাইয়া রাজশক্তির কবলে পড়িয়া দামেস্কে উহা পচিয়া গেল এবং আব্বাসীয় রাজশক্তির কবলে পড়িয়া বাগদাদে উহা মরিয়া গেল। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নাম উল্লেখের সঙ্গে তাঁহাদের জন্য যথাযযাগ্য সম্মানসূচক কথা নামের সঙ্গে পুনঃপুনঃ লেখা হয় নাই। আশা করি পাঠক-পাঠিকাগণ। তাঁহাদের নামের সঙ্গে যথাস্থানে যাহা পঠনীয় তাহা পড়িয়া লইবেন। যথা : ‘আলাইহে সালাতু আস্সালাম’, ‘আলাইহে সালাম, সালামাল্লাহে আলাইহে’ অথবা সালামাল্লাহে আলাইহা, “রাজি ‘আল্লাহু আনহু, রহমতুল্লাহ আলাইহে, হযরত ইত্যাদি। এইরূপ না পড়া কার্পণ্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেয়াদবীও বটে।