“ডেল কার্ণেগী রচনাসমগ্র”বইটির ভূমিকা:
নিউইয়র্কে, পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমিই ছিলাম সবচেয়ে দুখী ছেলে। জীবিকার জন্য আমি মােটর ট্রাক বিক্রি করতাম। মােটর ট্রাক কীভাবে চলে আমি জানতাম না, জানার ইচ্ছেও ছিল না। আমার কাজকে আমি ঘৃণা করতাম। আরশােলায় ভরা ওয়েস্ট ফিফটি সিক্সথ স্ট্রিটের একটা সস্তা কামরায় বাস করতেও আমার ঘৃণা হত। আমার মনে পড়ছে একদিন দেয়ালে টাঙানাে একটা টাই নিতেই একগাদা আরশােলা ছড়িয়ে পড়েছিল। নােংরা সব রেস্তোরাঁয় খাবার খেতেও আমার ঘৃণা হতাে। সেখানেও আরশােলা ছড়িয়ে থাকত।
প্রতিদিন রাত্তিরে দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে এসে পৌঁছতাম-হতাশ, চিন্তা, তিক্ততা আর বিদ্রোহের চিন্তায় সেই মাথার যন্ত্রণা। বিদ্রোহের কথা জাগতাে আমার কলেজের সেই স্বপ্নের কথা ভেবে। ভবিষ্যৎ জীবনের কত স্বপ্নময় ছবিই না সে সময় আঁকতাম-আজ সেসব হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্ন। এটাই কি জীবন? যে স্বপ্নবিষ্ট ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি এটা কি তাই? এটাই কি আমার কাছে জীবনের অর্থ-যে কাজ পছন্দ করি
তাই করা, আরশােলাময় ঘরে থাকা, নােংরা খাবার খাওয়া-আর ভবিষ্যতের কোন আশা না রাখা? …আমি শুধু চাইতাম পড়তে আর কলেজ জীবনে যে বই লেখার স্বপ্ন দেখতাম আমি লিখতে।
| আমি জানতাম যে কাজ পছন্দ করি না সেটা ছেড়ে দিলে লােকসানের বদলে আমার লাভই হবে। আমার কাড়ি কাড়ি টাকা চাই না, আমি চাইতাম ভালােভাবে বাঁচতে। ছােট্ট করে বললে আমি একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছিলামএমন অবস্থা নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়া সব তরুণ তরুণীর জীবনেই একসময় আসে। অতএব আমি আমার মনস্থির করে ফেললাম-আর সেই সিদ্ধান্ত আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। সেই থেকে গত পঁয়ত্রিশ বছর আমি জীবনে যে সুখ আর সমৃদ্ধির স্বাদ পেয়েছি তা আকাশকুসুম উচ্চাশারও বাইরে।
আমি যা ঠিক করলাম তা এই : যে কাজে ঘেন্না হয় সেটা আমি ছেড়ে দেব, আর যেহেতু মিসৌরির ওয়ারেনসবুর্গের স্টেট টিচার্স কলেজে চার বছর পড়াশুনা করেছি, তাই রাত্রে বয়স্কদের শিক্ষাদান করে আমার জীবিকা অর্জন করব। এরপর আমি সারাদিন বই পড়ার সময় পাবাে, শিক্ষাক্রম তৈরি করব, উপন্যাস আর ছােট গল্প লিখব। আমি চাই লেখার জন্য বাঁচতে, আর লিখে বাঁচতে’।
বয়স্কদের রাত্রিবেলায় কী বিষয় শেখাব? আমার কলেজজীবনের কথা চিন্তা করতেই মনে পড়ল আমি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেয়ার যে শিক্ষা পেয়েছি আর অভিজ্ঞতা হয়েছে সে আমার কলেজ আর অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি। কেন? কারণ ওই শিক্ষার ফলেই মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পক্ষে আমি সাহস আর নিশ্চিন্ততা অর্জন করেছি, আমার ভীরুতা আর আত্মবিশ্বাসের অভাব দূর হয়ে গেছে।
স্বভাবতই আমি কলম্বিয়া আর নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের ক্লাসে বক্তৃতা দেয়া শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে শিক্ষকপদে নিয়ােগের আবেদন করি। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি জানাল তারা আমার সাহায্য ছাড়াই চালাতে পারবে।