সমালোচনা-সাহিত্য সাহিত্যের একটি প্রধান শাখা। যখন থেকে সৃজনশীল সাহিত্যের সূচনা ঘটেছে, প্রায় তার সমকালে সেই-সাহিত্যকে বোঝার জন্য, তার রসোপলব্ধির জন্য সমালোচনা-সাহিত্যও বিকশিত হয়েছে। হোমার, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস ও ভবভূতির সৃষ্টিকর্ম কেন অনন্যসাধারণ এবং তাঁদের সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য কোথায়—সেকথা প্লেটো, এরিস্টটল, লনজিনাস, ভরত, আনন্দবর্ধন, বিশ্বনাথ প্রমুখ সাহিত্যসমালোচক যে-ব্যাখ্যার মাধ্যমে উদ্ভাসিত করেছেন, তা নিজেই এক অভিনব সাহিত্যে পরিণত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলায় যে-অচিন্তনীয় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তা ছিল মুখ্যত সাহিত্যকেন্দ্রিক। ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সে সময় বাংলা জুড়ে অর্থনৈতিক দৈন্য বিস্তৃতি লাভ করলেও ইংরেজির মাধ্যমে ইউরোপীয় মননের ঐশ্বর্যের সঙ্গে আমাদের যেগভীর সম্পর্ক ঘটে, তার ফলে কবিতা, সংগীত, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, সমালোচনা-সাহিত্য ও শিল্পকলা যে অভূতপূর্ব ও বহুমুখী বিকাশে সমৃদ্ধ হয়, তা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। সে সময় যাদের হাতে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা বাংলা সমালোচনা-সাহিত্য অসাধারণ ঋদ্ধি অর্জন করে, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ও প্রধানতম ছিলেন কবি-সমালোচক শশাঙ্কমোহন সেন। বস্তুত তিনিই বাংলা তুলনামূলক সমালোচনা-সাহিত্যের জনক। অধ্যাপক আহমদ শরীফ ‘বিশ শতকে বাঙালি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেও বলা চলে বাংলা ভাষায় প্রতীচ্য আদলের ও মানের সাহিত্য সমালোচনা প্রথম শুরু করেন কবিভাস্কর * শশাঙ্কমোহন সেন (১৮৭২-১৯২৮), দ্বিতীয় ব্যক্তি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২); তারপর আমরা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ সেনগুপ্ত, নীহাররঞ্জন রায়। প্রমুখ অনেকতায় বহু সমালোচক প্রাবন্ধিক পেয়েছি। সাহিত্যের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণমূলক ইতিহাসকার রূপে পেয়েছি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৬), সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ।” বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত বিনয় সরকার, যিনি বাংলার বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত, সেই বিদগ্ধ পণ্ডিত ‘প্রবাসী’তে লিখেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্যের খবর বলতে পারেন দু’জন ব্যক্তি-অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও শশাঙ্কমোহন সেন।” সমালোচক শশাঙ্কমোহন অনন্য, অসাধারণ। সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি যে-গভীর তল স্পর্শ করেছেন সেখানে তার কোনো সহযাত্রী নেই। কিন্তু তার পরিচয় কেবলমাত্র সমালোচনার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি মৌলিক কবি-প্রতিভার অধিকারী। এই গ্রন্থে শশাঙ্কমোহনের সমালোচনার বিশাল ব্যাপ্তি ও অতলস্পর্শী গভীরতার কয়েকটি দিকমাত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কবি-পরিচয়ের বিস্তৃত কোনো ব্যাখ্যা এখানে নেই।