লেখক পরিচিতিঃ
একজন লেখককে হতে হয় চাষী। তিনি তৈরী করবেন ধৈর্যের বীজতলা। সেখান থেকে মাথা তুলবে শব্দের চারাগাছ। সময় মতো ফলবে বাক্যের ফসল। সে ফসল মলাটবদ্ধ হয়ে উঠবে বাজারে। আর পাঠকরা তা বাজার থেকে কিনে মেটাবেন পাঠের ক্ষুধা।
এই তো সমীকরণ! একজন লেখক সারাটা জীবন ভরে এই সমীকরণ মিলিয়ে চলেন। সার্জিল খানও গদ্য লিখছেন। অপেক্ষায় আছেন ওপরের সমীকরণ মেলাবার। তবে পাঠকরা যেমনভাবেই গ্রহন করুক না কেন সার্জিল খান তাঁর লেখনী চালিয়ে যাবেন একথা বাজি ধরে বলা যায়। কারণ পরাজয়ে ডরে নাকো বীর। আর বিজয়ে তোলে না পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর। সফল লেখকরা মহাকালের দৃষ্টিতে এক একজন সাহসী যোদ্ধা। আমি নিজেও নবীন। সার্জিল খানের তারুণ্যে নিজেকে অনুপ্রাণিত করি সবসময়। এক বইমেলায় ছয় ছয়টি গ্রন্থের সম্পাদনা করা সহজ কথা নয়। সম্পাদনার পাশাপাশি তাঁর কলমও ধারালো হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত।
বাবা হাসানুজ্জামান খান ও মা সুফিয়া সুলতানার ছোট ছেলে তিনি। পৈতৃক নাম এইচ. এম. সাদী খান। ১৯৯২ সালের ২রা জুলাই (অবশ্য এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৯৪) জন্মগ্রহন করা এই তরুণ বর্তমানে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছেন। লেখালেখিতে প্রথম অনুপ্রেরণা দেন প্রিয় শিক্ষক অক্ষয় স্যার। এরপর হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ে-হাতে কলম নেওয়া। বর্তমানে ‘উন্মাদ’ এর সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট ও সাহিত্যিক আহসান হাবীব দিয়ে চলেছেন নিরলস অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ।
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মদের কাছে প্রকৃত পক্ষেই কঠিন একটি বিষয়। কি রকম ভয়াবহতার মাঝে, আবেগের মাঝে, প্রতিশোধের মাঝে এদেশের সাত কোটি মানুষ নয়টি মাস করেছিলো, সে ধারণা আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মরা কল্পনাও করতে পারবো না। অনেকটা- যে অন্ধ লোক জীবনে হাতি দেখেনি সে হাতির গঠন কেমন তা বুঝবে কি করে? তবে এরপরেও দুঃসাহস দেখিয়ে উপন্যাসটি লিখেছি। কারণ এই গভীরতাটি ফুটিয়ে তোলা যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মদের কাছে আজকেও যেমন কঠিন, তেমনি যখন বয়স বাড়বে তখনও ঠিক একই রকমের কঠিনই থাকবে। আর এই দুঃসাহস দেখিয়েছি শুধুই আবেগ থেকে। যদি কিছুটা আবেগকে ভাগাভাগি করা যায় প্রজন্মের আমার সমসাময়িক বয়সের মানুষদের সাথে। শুধুমাত্র এজন্যই এই দুঃসাহস। তবে এই উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই পড়তে হয়েছে। আহসান হাবীব স্যারের ৭১’র রোজনামচা বইয়ের কিছু গল্পকে কেন্দ্র করে এবং বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী ও যোদ্ধাদের মুখ থেকে শোনা বিভিন্ন কাহিনীর সংমিশ্রণে লেখাটি লিখে শেষ করলাম। এটি কেবলই যুদ্ধ ভিত্তিক একটি উপন্যাস। কোন ইতিহাসের দলিল নয়।
উপন্যাসটা কোন ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সময়কার ঘটনাগুলো প্রথমে সংগ্রহ করেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক সকল রকমের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গিয়ে কেবল সাধারণ মানুষদের যুদ্ধের সময়কার আতঙ্কা, উৎকণ্ঠা, আত্মত্যাগের কথাই তুলে এনেছি এই কাহিনীতে। সেই সাথে বিশেষ করে প্রাধান্য দিয়েছি ঘরের শত্রু বিভীষণ আলবদর,রাজাকারদের দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে অত্যাচারের কিছু দিক। অত্যাচারের দিকগুলো আমি তেমন খোলামেলা করে দিইনি। তারা যে অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিলো, তা আমার পক্ষে সরাসরি লেখাটা খুবই কষ্ট সাধ্য একটা ব্যাপার ছিল। এটি উপন্যাস কোন ঘটনার বীভৎস বর্ণনার রচনা না।
উপন্যাসটি পাঠক প্রিয় হবে কি না তা আমি বলতে পারি না। কারণ লেখকের শ্রেণীও যেমন আলাদা, তেমনি পাঠক শ্রেণীও আলাদা। রম্য গল্পের পাঠকদের কাছে এই উপন্যাসটি হয়তো বা তেমন ভালোলাগার মতন কোন উপন্যাস হবে না। তেমনি একজন কেবলই ভৌতিক বা সায়েন্স ফিকশন গল্পের পাঠকরা পছন্দ করবেন ভৌতিক বা সায়েন্স-ফিকশন জাতীয় রচনা। মূলত এই উপন্যাসটি পাঠকদের সামনে আমার কল্পনা শক্তির বিচারে সাহায্য করবে। জানি না পাঠকদের কাছে বইটি কেমন লাগবে? তবে লেখাটি লিখে কখনো বা কেদেছি, কখনো বা উত্তেজনায় পুরো শরীর শিহরিত হয়ে গেছে, কখনো বা সেইসব মানুষদের জন্য বুকের ভেতরে মোচড়ে উঠেছে। শুরু থেকে যে প্লাটফর্ম ধরে এগুচ্ছিলাম, সেই প্লাটফর্ম আর শেষ করতে পারিনি। লেখালেখির এই এক দোষ, গঁৎবাধা কোন কিছু দিয়ে লেখা যায় না।
কি জন্য জানি না, যখন কোন কিছু লিখবার সময় অনেক আগ্রহ, আনন্দ নিয়ে লেখা শেষ করি। কিন্তু লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই মনে হয় কিচ্ছুই হয়নি। যেভাবে লিখতে চেয়েছি, সেভাবে লিখতে পারিনি। জানি না ইচ্ছা থাকলেও কতদিন লেখালেখি করতে পারবো, তবে যতদিনই করি বা না’ই করি একটি নাম আমার সব সময়ই মনে থাকবে। যিনি ছাড়া আমার লেখাগুলো শুধু ফেসবুকের ওয়াল, ব্লগের পোস্ট, মাঝেমধ্যে দুই একটা পত্রিকা-ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। আহসান হাবীব স্যার আমার এই বইয়ের নেপথ্যের কারিগর। তাঁর উৎসাহ সহযোগিতা না পেলে লেখালেখির জগৎে হয়তো আসাই হতো না। স্যার আমাকে তাঁর অসম্ভব ব্যস্ত সময়ের মাঝে কিছুটা সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ যত্ন নিয়ে বইটির প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন, সেটা যখন প্রথম দেখি, তখন বুঝতে পারলাম আমার চোখ দুটি সামান্য ঝাপসা হয়ে এসেছে। স্যারকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শুভকামনা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
টাকা দিলে সবকিছু করাই নাকি সম্ভব। এই ধারণাকে মিথ্যা করে দিয়ে আদী প্রকাশন এর সাজিদ ভাই আমার বইটি ছাপাতে আগ্রহী হলেন। আমার সন্তানসম বইটি পাঠকদের গ্রহনযোগ্যতার মধ্য দিয়ে আলোর মুখ দেখবে, এটাই আমার আত্মবিশ্বাস! কি মনে করে তিনি আমার উপর ভরসা করে এই বইটার কাজ নিলেন জানি না। কতটুকু পেরেছি বা কতটুকু পারবো তাঁকে ও আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের এই ভরসার প্রতিদান দিতে সেটিও জানি না। তবে চেষ্টা, পরিশ্রম আর একাগ্রতা এই জিনিসটা কিভাবে কিভাবে যেন আমাকে পেয়ে বসেছে সেই ছোটবেলা থেকেই- আমার ভরসা এই তিনে।
প্রথম বই প্রথম সন্তানের মতোই। সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র যেমন আবেগ কাজ করে লেখকেরও কি তারচেয়ে কম আবেগ কাজ করে? প্রশ্নের উত্তরটা জানতে খুবই ইচ্ছা হয়।
বাংলার সকল বীরযোদ্ধারা গাজী বা শহীদ হয়ে শান্তিতে থাকুক। তরুণ প্রজন্মরাও যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও তথ্য জানতে আগ্রহী হউক, নিজেদের দেশ মাতৃকার প্রতি কিছুটা হলেও লিখুক, এটিই আমার চাওয়া।
সার্জিল খান
২১শে জানুয়ারি ২০১৩
উত্তর ছায়াবিথী, জয়দেবপুর, গাজীপুর