আরম্ভের আগে — গত ৩০ বছর ধরে হতাশ হবেন না বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তার এক বিশেষ স্থান অধিকার করে নিচ্ছে। পাঠকদের চিঠির স্রোত আজও অব্যাহত।
আমি নিজে সৃজনশীল লেখক। গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ রম্যরচনা লিখি। এই ধরনের বই লেখার প্রবণতা আমার ছিল না। কিন্তু বিষয়টি ধীরে ধীরে আমাকে পেয়ে বসে ও আমি আরও পড়াশােনা শুরু করে দিই। প্রথম খণ্ডটির অসাধারণ জনপ্রিয়তা আমাকে অনুপ্রাণিত করে পরবর্তী খণ্ডগুলি লেখার জন্য। মােট ছ খণ্ডে এই বই।
বর্তমান খণ্ডে আলােচনা করেছি স্ট্রেস নিরসনের পথ নিয়ে। একুশ শতকের আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হবে স্ট্রেস। পরমাণু বােমার চেয়ে স্ট্রেস হল বিধ্বংসী। কারণ পরমাণু বােমা একবারই যা কিছু ধ্বংস করে কিন্তু স্ট্রেস মানুষকে ধ্বংস করে তিলে তিলে। ভারতীয় শাস্ত্রে স্ট্রেস নিরসনের জন্য অসাধারণ সব পথনির্দেশ আছে। পাশ্চাত্যের মনস্তত্ত্ববিদ, চিকিৎসক ও চিন্তাবিদরাও ভারতীয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইছেন। আমরা স্ট্রেস সম্পর্কে সচেতন নই। বরং গভীর দুঃখের নানা বহিঃপ্রকাশকে আমরা ‘ন্যাকামি’, ‘ভাবপ্রবণতা’, ‘ছেলেমানুষি’এইসব বলে উড়িয়ে দিই। কিন্তু একজন মানুষ কেন দুঃখ পান। শােকাকুল হন, ক্রোধে উন্মত্তের মতাে আচরণ করেন, লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হলে হতাশ হন তা জানবার চেষ্টা করি না। স্ট্রেস এমন একটা জিনিস যা মূল থেকে উপড়ে ফেলতে না পারলে ওপর থেকে কিছু চাপা দিয়ে সাময়িকভাবে প্রশমিত করা যায় কিন্তু অবচেতন মনে তার বীজ বাসা বেঁধে থাকে। ধরুন আপনার মনােকষ্ট চাপা দেওয়ার জন্য মদ ধরলেন। উত্তেজনা কমানাের জন্য সিগারেট খেলেন। অথবা মুখ বুজে দিনের পর দিন অপমান অবহেলা মানসিক অত্যাচার সহ্য করলেন। দেখবেন প্রকৃতি একদিন তার প্রতিশােধ নিচ্ছেই। আমি এই বইতে স্ট্রেসের কারণগুলি ও তার স্থায়ী প্রতিকারের পথ নির্দেশ করেছি। আমার তত্ত্ব হচ্ছে আমাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুটোর জন্যই আমরা নিজেরা দায়ী। আমি সফল হয়েছি তার কারণ আমি চেষ্টা করেছি ও পরিস্থিতি আমার অনুকূলে ছিল। অথবা পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনবার জন্য যা যা দরকার তার সব কৌশল আমি শিখিনি অথবা শিখলেও তা কাজে লাগাইনি। অন্তত আর কে কি করেন জানি না। আমার নিজের জীবনের ব্যর্থতা, অপরিপূর্ণতা ও বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আমি সমাজ ব্যবস্থা বা ঈশ্বরকে দায়ী করি না। আমি নিজেকেই দায়ী করি। অনেক সময় আমরা পরিস্থিতির শিকার হই।
কিন্তু আমার কোনাে দুঃখ নেই। এই বই লেখার জন্য যখন পড়াশােনা শুরু করলাম তখন যেটুকু দুঃখ ছিল সেটুকুও চলে গেল। আমি আমার শক্তি ও সীমাবদ্ধতা দুটো সম্পর্কেই যত অবহিত হলাম ততই আমার ব্যক্তিগত স্ট্রেস চলে যেতে লাগল। এখন জীবন বলতে বুঝি, সীমিত শক্তির যথাসাধ্য প্রয়ােগ করে যতখানি নিজেকে বদলানাে যায় তার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে যাওয়া। মানুষের ভেতরটা না বদলে সমাজ বদলানাের চেষ্টা করা বৃথা। তাই আমার লক্ষ্য সমাজ নয়—ব্যক্তি। প্রতিটি ব্যক্তিকে পরিবর্তিত হতে সাহায্য করা। সে কাজে ইতিমধ্যেই আমি যে কিছু কিছু সাফল্য অর্জন করেছি পাঠকদের চিঠিপত্রই তার প্রমাণ।
আমার পাঠকদের মধ্যে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রকাশের ব্যাপারে যাঁরা ঐকান্তিক আগ্রহ দেখিয়েছেন তাঁদের সকলকেই আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার সঙ্গে আরও অনেকে আছেন। বহু নৈরাশ্যের ঢেউ ভেঙে জীবনের অপরাহ্নে এসে এই অনুভূতি আমাকে আরও কাজ করার প্রেরণা দেবে। উল্লেখ করা প্রয়ােজন আমার পুত্র তথাগত ও তার বন্ধু ডাঃ সুমন মিত্র আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে। প্রথম খণ্ড সম্পর্কে পাঠকেরা যেমন তাদের সম্ভাব্য মতামত ও সাজেশান পাঠিয়েছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ড সম্পর্কেও তেমন পাঠালে খুশি হবাে। তবে যাঁরা উত্তর চান, সঙ্গে জবাবি খাম দেবেনথ।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়