“হৃদয় চিরিয়া যদি দেখাতে পারিতাম” বইটিতে ফ্ল্যাপে লেখা কথাঃ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ওরা হেঁটেছিল পাশাপাশি। সাবরিনার পরনে ছিল নীল শাড়ী। তীক্ষ্ণ বনলতা চোখে সে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়েছিল সমুদ্রের বিশালতায়। সে চোখে ছিল রায়হানের প্রতি সাগরের মত উত্তাল ভালোবাসা। চোখের আলো ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে। বাতাসে সমুদ্র সৈকতে নীল শাড়ী উড়ছে। সাবরিনাকে ধরে বলে, কি সুন্দর সমুদ্রের বাতাস।
হাতে হাত রেখে সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে থাকে। কি এক মোহমায়ায় পরস্পর কাছাকাছি এসে ওম নেয়। উচ্ছ্বলতায় নিজেদের হারিয়ে ফেলে সমুদ্র সৈকতে। বাতসে উড়ে যাওয়া শাড়ী সাবরিনার দেহের অনেকাংশ অনাবৃত করে দেয়। সাদা মেঘের ভেলা কাটিয়ে বিমান উড়ে আকশে। বাংলাদেশের উদ্দেশে চলছে সাবরিনা। বিমানের দ্রুতগতি ওর কাছে মনে হয় খুবই ধীরগতি। সে যদি নিজেই উড়ে যেতে পারত মুহূর্তে, সেরকম কল্পনায় সে চায় রকেটগতি। তার মাঝে বিরাজ করে শূন্যতা আর শূন্যতা। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। মনে হয় কি যেন নেই, কিছু নেই। ভালোবাসার মানুষ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য সাবরিনা।
রায়হানের ভালোবাসার কাছে আজ সাবরিনা সত্যিই হেরে গেছে। সময়ের কাছে হার মেনে সাবরিনার ভালোবাসাকে হৃৎপিন্ডে ধারণ করে একাকী নিরবে কষ্ট যন্ত্রণায় জ্বলতে জ্বলতে রায়হান আজ শুয়ে আছে আইসিইউ তে। রায়হান অপারেশনকে ভয় করে না, মরতে একদিন হবেই কিন্তু রায়হানের কষ্ট হলো ভালোবাসার মানুষ সাবরিনা আজ কাছে নেই। ভালোবাসার মানুষটি যদি আজ কাছে থাকতো তবে রায়হানের ভালোবাসার মানুষটিকে অপারেশনের সময় কাছে রাখার জন্য ডাক্তারদের অনুরোধ জানাতো। যেন সাবরিনা দেখতে পারে রায়হানের হৃদয়ে সে আজো বসে আছে।
লেখক পরিচিতিঃ কথাসাহিত্যিক মঈনুদ্দিন কাজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া বিএ ও এলএলবি ডিগ্রি রয়েছে তার। ১৯৫৪ সালের ১২ নভেম্বর ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার দরবারপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল বাছেদ মজুমদার ও মা সামছুন্নাহার চৌধুরী। কলেজ জীবন থেকেই তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সম্পৃক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো তাঁর কৈশোর স্মৃতির সবচেয়ে বড় সম্পদ ও অহংকার, তাই শেকড়মুখী সংস্কৃতি ও সাহিত্য তার প্রেরণা। সত্তর দশক থেকেই তার ধারাবাহিক সাহিত্যচর্চায় উঠে এসেছে অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের উৎস থেকে মানুষের ভাঙাগড়ার জীবন-জীবিকার সংগ্রাম, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার দ্বন্দ্ব। তিনি বিনয়ী প্রাণবন্ত হাস্যোজ্জ্বল নিরহংকারী ও পরোপকারী একজন মানুষ। শিশুদের তিনি ভালবাসেন। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক।
মঈনুদ্দিন কাজলের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : হৃদয়ের সুর, শ্রমজীবীর পালা, কণ্ঠে জীবনের স্লোগান, চারদিকে রাজাকার, রূপবতী, চন্দ্রালোকিত রাত, ঘরের ভিতর সাপ, একাত্তরের মেয়ে, বুকের মধ্যখানে, কৈরবী, পরীর সাথে বন্ধুত্ব, ইয়াবা সুন্দরী, তোমার মাঝে আলো দেখেছি, বৈশাখী মেয়ে, আবদুল হালিমের সৌদিযাত্রা, মেধাবী মেয়ে, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, নির্বাচিত ছোটগল্প, তুমি আমার, মুক্তিযুদ্ধে জুই পলাশ, মুক্তিযুদ্ধে মায়াবতী, মায়াময় স্পর্শ, সাতটি নির্বাচিত উপন্যাস, নীলগিরি নীলাচল, তোমার আমার ভালোবাসা, দশটি নির্বাচিত উপন্যাস ইত্যাদি। নিরলস সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন থেকে যেসব পুরস্কার পেয়েছেন তা হলো- মুক্তধারা একুশে সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৪, নিপা স্বর্ণপদক ২০০১, আবদুল হামিদ ভাসানী স্বর্ণপদক ২০০৪, নন্দন সাহিত্য পুরস্কার ২০০৫, রাইটার্স ফাউন্ডেশন এওয়ার্ড ২০০৫, স্বাধীনতা সংসদ পুরস্কার ২০০৬, ময়মনসিংহ সেবা সম্মানপদক ২০০৬, হিউম্যান রাইটার রিভিউ সোসাইটি এওয়ার্ড ২০০৬, নবকল্লোল পুরস্কার ২০০৬, আয়োজন সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ২০০৬, রোদষী কৃষ্টি সংসদ ২০০৭, আলোর ভুবন এওয়ার্ড ২০০৭, শিশু সংগঠন ঐক্যজোট পুরস্কার ২০০৭, বাফেসাফ স্বর্ণপদক ২০০৭, পদক্ষেপ বাংলাদেশ পুরস্কার ২০১০, মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪। তার রুচিশীল লেখা, সাহিত্য শিল্পমূল্য সহজেই মননশীল পাঠককে আকৃষ্ট করে। নিষ্ঠা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তিনি লিখেন কম কিন্তু যা লিখেন তার সাহিত্য মূল্য রয়েছে অপরিসীম। একজন সুসাহিত্যিক হিসাবে কথাসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভুবনে সামাজিক, প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাস লেখক হিসাবে পাঠকের কাছে ভবিষ্যতেও তাঁর উপস্থিতি অব্যাহত থাকবে এ প্রত্যাশা সকলের।