কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন : তাঁর স্মৃতি ও সত্তা আহমাদ মাযহার গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যে লেখকদের সক্রিয়তা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন তাঁদের অন্যতম। লেখাই তাঁর জীবন, ধ্যানজ্ঞান। আধুনিক জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যিক সক্রিয়তার ধারাবাহিকতা এই উভয় দিক থেকেই তিনি আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়। সাহিত্যিক সংগ্রামই তাঁর জীবনসংগ্রাম। পেশাগত জীবনে কিছুকাল সাংবাদিকতা এবং শিক্ষকতা করলেও তা ছিল তাঁর সাহিত্যিকতারই সংগ্রাম। কিশোর বয়সেই সাহিত্য-ভুবনের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। একজন সাহিত্যিককে এমনিতেই সমাজের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে হয়। সেখানে গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পটভূমিতে একজন নারীর পক্ষে সেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। অগ্রগণ্য সাহিত্যিক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম যে এখনো যথার্থ মনোযোগে বিচার করে দেখার অপেক্ষায় আছে আশি বছর পূর্তির লগ্নে তাঁর সৃষ্টিকর্মের দিকে চোখ ফেরালে এ-কথা আমাদের অনুভবে আসে। সংখ্যার দিক থেকে রাবেয়া খাতুনের গ্রন্থের পরিমাণ বিপুল। মোটাদাগে তাঁর রচনাসম্ভারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। একদিকে তিনি ঔপন্যাসিক, অন্যদিকে ছোটগল্পকার; শিশুসাহিত্যের লেখক হিসেবেও তিনি সমাদরণীয়। ভ্রমণ যেমন তাঁর শখের বিষয় তেমনি তা আবার সাহিত্যেরও উপকরণ! স্মৃতিসাহিত্যও কথাসাহিত্যিক সত্তারই ভিন্নতর সম্প্রসারণ। অথচ বিপুলবিচিত্র রচনারাশির মধ্যে ছড়িয়ে থাকায় রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিকথার তাৎপর্য অনুভব কঠিন। তাঁর স্মৃতিকথার গুরুত্ব অনুভব করতে হলে সবগুলো স্মৃতিকথা একত্রে পড়ে দেখা দরকার। একাত্তরের রুদ্ধশাস দিনগুলোর স্মৃতিকথা একাত্তরের নয়মাস দিয়ে স্মৃতির প্রথম ঝাঁপি খুলেছিলেন রাবেয়া খাতুন; এরপরের উন্মোচন সুদূর কিশোরীবেলায় পুরনো ঢাকায় বাসকালের স্মৃতিকথা স্বপ্নের শহর ঢাকা। পরের বই সরাসরি নিজের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কিত আত্মজীবনীমূলক বই জীবন ও সাহিত্য। বাংলা ভাষার কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত জানাশোনা-সূত্রে পরবর্তী স্মৃতিমালা স্মৃতির জ্যোতির্ময় আলোয় যাঁদের দেখেছি। এখানে লিখেছেন আহসান হাবীব, সুফিয়া কামাল, মিরজা আবদুল হাই, জহির রায়হান, গৌরকিশোর ঘোষ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হাসান হাফিজুর রহমান, আশাপূর্ণা দেবী, জাহানারা ইমাম, সমরেশ বসু, জোবেদা খানম, খান আতাউর রহমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ও মুক্তিযোদ্ধা কবি মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে। তার পরের বই পরিবারের প্রয়াত নিকটাত্মীয়দের স্মৃতিকথা চোখের জলে পড়ল মনে; তবে এই সংকলনে পারিবারিক আত্মীয়দের বাইরের মানুষদের মধ্যে কেবল আছেন কবি শামসুর রাহমান। আরও লিখেছেন পাবনা মানসিক হাসপাতাল নামে ভিন্নধর্মী আরেক স্মৃতিকথা। এ নিছক পাবনা মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনের স্মৃতি নয়, সেখান থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির ভাষ্য! রাবেয়া খাতুন তাঁর গল্প-উপন্যাসে বাংলার মুসলিম সমাজজীবনের অন্তঃশীল অভিজ্ঞতার বয়ান রচনা করেন। আর এইসব স্মৃতিমূলক রচনায় তুলে ধরেন সুদীর্ঘ সাহিত্যিক সংগ্রামের স্বেদচিহ্ন; একই সঙ্গে বাক্সময় করেন সমাজমানসে অন্তঃশীল জাগরণ-আকাক্সক্ষাকেও। বিরাজমান ঔপনিবেশিক শাসনকাঠমো, ধর্মীয় আচারনিষ্ঠতার প্রাবল্য এবং চিন্তার অনড়তার মধ্যে একজন স্বাপ্নিক মানুষ হিসেবে কিভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন তার পরিচয় এই স্মৃতিকথাগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় তাঁর সমকালের যে বিশিষ্ট সাহিত্যিক বলয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন তারও গভীরতর পরিচয়। দেশমাতৃকার টানে আকস্মিকভাবে স্বামী চারসন্তানসহ তাঁকে একাকী ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে ব্যক্তিজীবনে ও পারিবারিক জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে সমগ্র বাংলাদেশের রুদ্ধশ্বাস পটভূমিতে তার বিবরণ আছে স্মৃতিকথায়। তিনি যেমন কথাসাহিত্যিক তেমনি ভ্রামণিকও। পাবনা মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনের উদ্দেশে যাওয়া তাই একই সঙ্গে হয়ে-ওঠে সাংবাদিকতা, ভ্রামণিকতা, সমাজ-পর্যবেক্ষণ ও সর্বোপরি একটি স্মৃতিকথার উপজীব্য। পাঠকমাত্রেই অনুভব করবেন, রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিমূলক রচনাগুলো যুগপৎ নিজের অভিজ্ঞতার বয়ান ও অনুভূতির রূপায়ণ! অথচ আবেগের উচ্ছ্বাস নেই এতে; গদ্যরীতি নির্মোহ ও সংযত। একজন যথার্থ কথাসাহিত্যিকেরই যা সংগত স্বভাববৈশিষ্ট্য। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ তাঁর ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের অভিমুখ নির্ধারণের জন্য পঞ্চাশাধিক বছরের সাহিত্যিক যাত্রায় তাঁর অবদানকে আরো গভীরভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। রাবেয়া খাতুনের সামগ্রিক সাহিত্যিকতায় তাঁর লেখা স্মৃতিকথাগুলোর যে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে মনে রাখা দরকার সে-কথাও।