“বঞ্চিত লাঞ্ছিত” বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
ফিওদর মিখাইলােভিচ দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্ম বঞ্চিত লাঞ্ছিত লিখতে শুরু করেন তাঁর ঊনচল্লিশ বছর বয়সে, ১৮৬০ সালে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লিখে তিনি উপন্যাসটি শেষ করেন ১৮৬১ সালের ৯ জুলাই তারিখে।
এই উপন্যাসটি উত্তমপুরুষে লেখা, উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাবলির সময়কাল মােটামুটি ১৮৪৫ সাল থেকে ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত। প্রায় আত্মজৈবনিক বলা হয়ে থাকে দস্তয়েভস্কির এ উপন্যাসটিকে। কেননা, ঔপন্যাসিকের প্রথমজীবনের সাহিত্যসাধনার স্মৃতি এবং সেইসঙ্গে লেখকবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুঃখ-কষ্ট ও কৃচ্ছ্বসাধনা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘অসফল সাহিত্যিক’ ইভান পেত্রোভিচের চরিত্রসৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
দস্তয়েভস্কি এই উপন্যাস লিখতে এক জটিল প্রকরণের সাহায্য নিয়েছিলেন। ইভান পেত্রোভিচ যে উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র, একইসঙ্গে ঘটনাবলিতে অংশ নিচ্ছে আবার অতীতের কথাও স্মরণ করছে। যেসব ঘটনা ইভান পেত্রোভিচ স্মরণ করছে এবং হালে সংঘটিত হয়েছে বলে পাঠকদের জানাচ্ছে, সেসব ঘটনাকে থামিয়ে দিয়ে আবার নিয়ে আসছে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনাসমূহের ব্যাখ্যা আর সেগুলাের সম্পর্কে মন্তব্য। উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের আনুপূর্বিকতা লঙ্ঘন করে বাড়িয়ে তােলা হয়েছে বিনােদন-গুণ; সেইসঙ্গে বেড়েছে ঘটনার সংখ্যা আর তাৎপর্য। উপন্যাসরচনার ক্ষেত্রে আপাত-জটিল এই প্রকরণের ব্যবহার ইতােপূর্বে লক্ষ করা গিয়েছে টলস্টয়-এর শৈশব (১৮৫২) আর যৌবন (১৮৫৪) গ্রন্থের রচনারীতিতে। বর্ণিত ঘটনা আর স্মৃতিচারণের কষ্টময় অনুভূতির বর্ণনার ক্ষেত্রে কালব্যবধান টলস্টয়-এর রচনায় আমরা পাই চরিত্রটির শিশুবয়স এবং বয়স্ককালের সময়ে, দস্তয়েভস্কি এই উপন্যাসে ব্যবধানটা দেখিয়েছেন। মাত্র এক বছর। কালব্যবধানের এই হ্রস্বতার পরিপূরণ করা হয়েছে ক্রিয়ার তীব্রতা, ঘটনার কেন্দ্রীভূতিকরণ এবং স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে ঘটনার নিবিড়তা দিয়ে। সক্রিয় চরিত্র হিসেবে ইভান পেত্রোভিচের উপস্থিতি, আবার একজন আখ্যায়ক হিসেবে তার অবস্থান— এই দ্বৈততা রূপায়িত করা সম্ভব হয়েছে এইজন্যে যে উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভান পেত্রোভিচ নিজেই একজন পেশাদার সাহিত্যিক।
বাস্তব জীবনের ঘটনাবলিতে ইভান পেত্রোভিচ নিজে আলােড়িত হয়েছে সেইসঙ্গে এই ঘটনাপ্রবাহকে অচেতনভাবে সে দেখছে তার সাহিত্যের উপকরণ হিসেবেও।
মাঝে মাঝে আবার বাস্তব লােকজন ইভান পেত্রোভিচের কাছে হয়ে ওঠে যেন সাহিত্যের পাত্রপাত্রী, উঠে এসেছে যেন তার প্রিয় কোনাে লেখকের বইয়ের পাতা থেকে। চিরায়ত রুশ সাহিত্যের ক্ষেত্রে উত্তমপুরুষে ঘটনাকথনের একটা নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন দস্তয়েভস্কি; আর তা সম্ভব হয়েছে ইভান পেত্রোভিচের ‘সাহিত্যিকতা’-য়। উপন্যাসটির অন্যদুটি প্রধান চরিত্র ‘নেল্লি’ আর ‘নাতাশা’-কে মেলানাে সম্ভব হয়েছে সেই একই কারণে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভান পেত্রোভিচের মানবিক বােধ ও সাহিত্যিক আগ্রহ পরস্পর বিজড়িত হয়ে গেছে এ উপন্যাসে। অপরের জীবন ও ভাগ্যে তার হস্তক্ষেপ যেন সেই সক্রিয় লােকহিতৈষণা ও সামাজিক মানবতারই প্রলম্বিত রূপায়ণ, যাতে অনুপ্রাণিত হয়েছে ইভান পেত্রোভিচের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসের অন্য প্রধান দুটি নারীচরিত্রের প্রতি তার সমস্ত আচরণ প্রণােদিত হয়েছে একটা সঙ্গতিশীল নিখাদ পরার্থপরতায়, সমস্ত ভাগ্যপীড়িত ও লাঞ্ছিতদের প্রতি ভ্রাতৃকল্প ভালােবাসায়, জুলুম আর স্বার্থপরতার বিপরীতে ভালােবাসার পক্ষ নেবার একটা স্বাভাবিক প্রবণতায়। রুশ পত্রিকা ‘ভ্রেমিয়া’-য় দস্তয়েভস্কি নিজের যে মানবতাবাদী কর্মসূচি পেশ করেন, তাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন ইভান পেত্রোভিচের চরিত্রে।
এ উপন্যাসের দুটি ধারায় অন্বয় ঘটেছে তাদের আনুরূপ্যের কারণে। প্রিন্স ভালকোভস্কি বুড়াে স্মিথের কন্যাকে প্রতারণার মাধ্যমে ছেড়ে যায়। প্রিন্সের পুত্র আলিওশা’র আচরণও প্রায় একই সে নাতাশাকে ত্যাগ করে অপর দয়িতা ‘কাতিয়া’র জন্যে। বৃদ্ধ স্মিথ তার কন্যাকে অভিশাপ দেয়, তাকে ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে আলিওশা’র কাছে চলে যাওয়ায় ইখমেনেভ অভিশাপ দেয় তার কন্যা নাতাশাকে। শেষপর্যন্ত নেল্লির কাছে শােনে তার মা হতভাগিনী স্মিথকন্যার বিবরণ আর তখনই কেবল ইখমেনেভ রাজি হয় কন্যা নাতাশাকে ক্ষমা করে দিতে।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রটেস্ট্যান্ট ধারায় ঈশ্বরের যে নিষ্করুণ রূপ আর বাইবেলে বর্ণিত দণ্ডদাতা বিধাতার অপ্রশম্য কঠোরতা— তার বিপরীতে দস্তয়েভস্কি তুলে ধরেছেন খ্রিস্টানধর্মের নৈতিক ভাষ্য— ন্যায় আচরণের দৃঢ়তা, অশুভের প্রতি আপসহীনতা, সৌভ্রাত্র-প্রেম-তিতিক্ষার জয়ধ্বনি তুলে ধরা হয়েছে অব্যাহত দৃঢ়তার সঙ্গে এ উপন্যাসে।
সমাজে বিদ্যমান স্বার্থপরতার সমস্যা নিয়ে দস্তয়েভস্কি ভাবিত ছিলেন ১৮৪০-এর দশক থেকেই। নৈতিক-সামাজিক যে মূলপ্রশ্নের সমাধানে ইভান পেত্রোভিচ আলােড়িত হয়েছে সেটা মূলত স্বার্থপরতার সমস্যা। বঞ্চিত লাঞ্ছিত উপন্যাসে প্রিন্স ভালকোভস্কির মুখ দিয়ে জীবনের পুরাে একটা নির্লজ্জ নীতিবিগহিত মতবাদ বলিয়ে নিয়ে দস্তয়েভস্কি ফিরে আসেন ব্যক্তিমানুষের অহংসর্বস্ববাদী আত্মসমর্থন এবং তার স্বার্থগৃধু প্রয়াসের সমালােচনায়। উপন্যাসে এর বিপরীতে রাখা হয়েছে বঞ্চিত এবং ভাগ্যপ্রপীড়িত, লাঞ্ছিতদের ভালােবাসা আর ভ্রাতৃত্ব। এই বঞ্চিতরা নিজেদের উৎপীড়িত ভাগ্যের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রতি আক্রোশ বােধ করলেও তাদেরই মতাে অন্যান্য বঞ্চিত, লাঞ্ছিতদের প্রতি ক্ষমাশীল, সমবেদনায় কোমল।
এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র আলিশা যেন অবিমৃষ্য, অনাবৃত, নির্লজ্জ স্বার্থপরতার এক মূর্ত প্রতিচ্ছবি। নেল্লি, বৃদ্ধ ইখমেনেভ, আলিওশা—এদের মানসিকতার বৈপরীত্যে প্রকাশ পেয়েছে তাদের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন। এই চরিত্রগুলাের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিণতিলাভে আমরা দেখতে পাই নেল্লি যুগপৎ সদয় আর হিংস্র, মানবিক মায়ার জন্য কাতর অথচ লােকের প্রতি নিষ্ঠুর। আলিওশা খােলামেলা সরল মনের এক খােকাবাবু, অথচ মেরুদণ্ডহীন ও চরম স্বার্থপর। বৃদ্ধ ইখমেনেভ তার স্ত্রী আর কন্যার প্রতি পরম মমত্বশীল হলেও কখনাে কখনাে তাদের প্রতি চরম নির্মম।
দস্তয়েভস্কির লেখকসত্তার একটা নতুন পর্যায় সূচিত হয়েছে এই উপন্যাসে। তৎকালীন সমাজজীবনের যেসব সংঘাত ও বিরােধ বাস্তবে ছিল সমাধানের অতীত, প্রধানত সেগুলাের প্রতি মনােযােগ দিয়েছেন তিনি। ইভান পেত্রোভিচের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আর ভালােমানুষি সত্ত্বেও, অভিজাত আর ধনীদের যে স্বার্থপরতা ও ঔদাসীন্য লােকেদের মধ্যে মনােমালিন্য ঘটায়, পরস্পরকে একে অন্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তােলে, তার বিপরীতে বঞ্চিত ও লাঞ্ছিতদের মানবিকতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা তুলে ধরার জন্যে বৃদ্ধ ইখমেনেভের প্রয়াস সত্ত্বেও এ উপন্যাস শেষ হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ব্যক্তিগত সুখের অবসানে, নেল্লির মৃত্যুতে।
দস্তয়েভস্কি দেখিয়েছেন যে, নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষা করা, নিজের মতাে হয়ে থাকার জন্যে মানুষের প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা লাভ করে না আর এইসব মানুষদের অনেকেই যারা স্বাভাবিক পরিণতিতে রােগভােগে মৃত্যুবরণের সুযােগ পায় না— তারা পৌঁছে যায় কার্কশ্যে, অসামাজিকতায় আর মস্তিষ্কবিকৃতিতে, নয়, স্রেফ মন্থর নীরসতায়। এই মানুষেরা শেষপর্যন্ত নেমে আসে তাদের মানবপ্রকৃতি দমনের পর্যায়ে, মানুষের চেয়ে সে অনেক নীচুস্তরের প্রাণী— এমন একটা আত্মস্বীকৃতিতে। তেমন মানুষ অনেক আছে যারা এই শেষােক্ত চেতনা নিয়েই যেন জন্মায়, নিজের মানবিক তাৎপর্য বিষয়ে ভাবনা যাদের জীবনে অনুপস্থিত থেকে যায়।
এই অধঃপতন, মানবিক সম্পর্কের এই ব্যত্যয়ের কারণ কী? কী করে তা ঘটে? এ ধরনের ঘটনার মূল বৈশিষ্ট্য কী? কীই-বা তার পরিণাম? এসব প্রশ্নেই স্বাভাবিক ও অমােঘরূপে পাঠকদের টেনে নিয়ে যান দস্তয়েভস্কি তাঁর এ উপন্যাসে।
ফরীদুল আলম