জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাঁর বক্তব্য কিছুটা খ-ন করে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ইতিহাস আপনা থেকে পুনরাবৃত্তি হয়। তবে প্রথমবার যদি তা ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়বার তা হয় প্রহসন।
কিন্তু ট্র্যাজেডির ইতিহাস কি পুনরাবৃত্তিতে ট্র্যাজেডি হতে পারে না? পারে। কীভাবে পারে, তা-ই দেখিয়েছেন স্বকৃত নোমান তার ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। চার শ বছর আগে মগ-ফিরিঙ্গি হার্মাদরা বাংলার উপকূল থেকে মানুষদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত আরাকান ও দাক্ষিণাত্যের বন্দরে বন্দরে ইংরেজ, ফরাসী এবং ওলান্দাজ বণিকদের কাছে। এটা বাংলার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। চার শ বছর পর প্রায় একই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেই ট্র্যাজেডি হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। সমুদ্রপথে এই মানবপাচার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়াগামী বহু বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় পথেই মারা যায়। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আবিষ্কার হয় মালয়েশিয়া গমণেচ্ছুদের বহু গণকবর। মানবপাচারের এই মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বকৃত নোমান লিখেছেন ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাসটি। লেখক তার শৈল্পিক কুশলতায় দেখিয়েছেন এটা যে ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি। ঘটনার প্রতিবেদন নয়, মূলত ইতিহাস ও সমকালের এই দুই বাস্তবতাকে উপন্যাসের আঙ্গিকে তিনি ধরেছেন খুব সফলভাবে।
খুব বড় নয় উপন্যাসটি। মাত্র দুই শ পৃষ্ঠার। কাহিনি বুননের একটা নিজস্ব রীতি রয়েছে স্বকৃত নোমানের। তিনি এমন এক রীতিতে কাহিনির বয়ান করেন, একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠক বইটি ছাড়তে পারে না। ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাসটির কাহিনিতে দেখা যায়, চার শ বছর আগে মগ-ফিরিঙ্গি হার্মাদরা অপহরণ করে সিতারাবানুর স্বামীকে। সিতারাকে তাড়া করে ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন : তার শিশুপুত্রকে গিলে ফেলেছে সাগরের মস্ত এক কুমির। চার শ বছর পর নূরনিসাকে তাড়া করে আরেক দুঃস্বপ্ন : ধনেশ পাখি হয়ে উড়ে গেছে তার এক শিশুপুত্র। স্বপ্ন কি বাস্তবে রূপ নেয়? নইলে সমুদ্র¯œানের সময় কেন উড়ে যায় নূরনিসার পুত্র শিবু? ভাগ্যান্বেষী শত শত আদম কেন চলে যায় হাঙর-কুমিরের পেটে?
এইসব প্রশ্ন করতে করতে লেখক প্রবেশ করেন বিষয়বস্তুর আরো গভীরে। পাঁচ শ তিরাশিজন যাত্রী নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে এমভি সাউথ বেঙ্গল-৩ নামে একটি জাহাজ যাত্রা করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। এই জাহাজেরই একজন যাত্রী রাহাত কমল, যে উপন্যাসের মূল চরিত্র। সে একজন গবেষক। তার গবেষণার বিষয় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সমকালীন প্রসঙ্গ।’ আদমপাচারকারীরা তাকে অপহরণ করে জাহাজটিতে তুলে দেয়। ভয়াবহ সব বিপদের সম্মুখীন হয় ভাগ্যান্বেষী আদমেরা। রাহাত কমল সেসব ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে।
উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, চার শ বছর আগের সিতারাবানু চার শ বছর পরেও জীবিত! বঙ্গোপ সাগরের তীরে সে স্বামীর ফেরার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এ কি আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এবং দুই শতাব্দীর মানব পাচারের দুই ঘটনাকে স্বকৃত নোমান কিভাবে গেঁথে দিয়েছেন শৈল্পিক-সুতোয়, পড়তে হবে ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাসটি।
স্বকৃত নোমান বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য একজন কথাসাহিত্যিক। উপন্যাসের জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায়। ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ তার অষ্টম উপন্যাস। এবারের বইমেলায় অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।