“হে আমার মেয়ে”বইটির লেখক পরিচিতি কিছু কথা:
বিংশ শতাব্দিতে যে সকল আরব মনীষী তাদের কলম আর যবানের মাধ্যমে দাওয়াতের ময়দানে বিশাল বড় অবদান রেখেছেন তাদের অন্যতম হলেন শায়েখ আলী বিন মুস্তফা আত-তানতাবী। সংক্ষেপে তিনি আলী তানতাবী নামেই সমধিক। পরিচিত। ১৯০৯ সালে সিরিয়ার দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শায়েখ মুস্তফা তানতাবি ছিলেন সিরিয়ার একজন নামকরা। আলেম। দামেস্কের ফতােয়া প্রদানের দায়িত্ব। তার কাঁধে অর্পিত ছিল। তার মায়ের বংশও ছিল অত্যন্ত খ্যাতিমান ও অভিজাত ।
ষােল বছর বয়সেই তাঁর পিতা মারা যান । পরিবারে তখন তাঁর মা এবং তারা পাঁচ ভাইবােন। তাদের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব নেওয়ার মানসে তিনি পড়াশােনা ছেড়ে দেওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলার দয়ায় তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন এবং পুনরায় পড়াশােনায় মন দেন।
১৯৩১ সালে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু । সেসময় তিনি আল আইয়াম’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সত্য কথনের দায়ে তৎকালীন সরকার সেটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিরিয়াতেই শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত থাকেন। সত্যবাদিতা আর সৎসাহসের জন্য এই সময় তাকে অনেক দুর্ভোগ পােহাতে হয়। তার উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে তিনি ইরাক গমন করেন। সেখানে বাগদাদের একটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়ােগ পান। এখানকার স্মৃতি নিয়েই পরবর্তীতে তিনি তার বিখ্যাত ‘বাগদাদ: মুশাহাদাত ওয়া যিকরিয়াত’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কয়েক বছর পর তিনি আবার মাতৃভূমি সিরিয়ায় ফিরে যান এবং দামেস্কে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেসময় সিরিয়া ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। তিনি এর বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন। দুঃসাহসিকতার জন্য তাকে তখন অনেক দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়। জার্মানির হাতে যখন ফ্রান্সের পতন হয় তখন তিনি জ্বালাময়ী একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি সিরিয়ার জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তােমরা ফ্রান্সকে ভয় করাে না। তাদের অন্তরগুলাে সারশূন্য। তাদের বীরতুপনা। কেবলই ফাকাবুলি । তাদের প্রজ্বলিত অগ্নি জ্বালাতে পারে না। তাদের ছােড়া বুলেট আঘাত হানতে পারে না। যদি তাদের মাঝে কল্যাণকর কিছু থাকতাে তবে জার্মান কখনও তাদের রাজধানী পদানত করতে পারতাে না।’ তার এই অগ্নিকণ্ঠের ভাষণ সেসময় সিরিয়ার লােকদের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বেশ উজ্জীবিত করেছিল। মূলত সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন আপােষহীন । ন্যায়ের পক্ষে সব সময় বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী।
এই ঘটনার পর তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে বিচারকার্যের সাথে সম্পৃক্ত হন। এবং দীর্ঘ সময় বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৬৩ সালে সৌদিআরব গমন করেন। সেখানে একটি কলেজে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। যা বর্তমানে ইবনে সউদ বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। এছাড়াও সৌদি অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ভাষণ প্রদান করেন।
ড. আলী তানতাবীকে আল্লাহ তাআলা অসাধারণ। লেখনী শক্তি দান করেছিলেন । যতােদিন বেঁচে ছিলেন দু’হাতে লিখে গিয়েছেন। তার প্রায় সব লেখাই প্রথমে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সেগুলােকে সংকলিত করে গ্রন্থের আকার দেওয়া হয়। তার বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ হল, আবু বকর সিদ্দিকিম (১৯৩৫), আখবারু উমর (১৯৫৯), আ’লামুত তারিখ (১৯৬০), বাগদাদ: মুশাহাদাত ওয়া যিকরিয়াত (১৯৬০), তারিফ আম বিদ্বিনীল ইসলাম (১৯৭০), আলজামেউল উমাবি ফি দিমাশক (১৯৬০), হেকায়াত মিনাত তারিখ (১৯৬০), রিজাল মিনাত তারিখ (১৯৫৮), সুওয়ার ওয়া খাওয়াতির (১৯৫৮), ফি সাবিলিল ইসলাহ (১৯৫৯), কাসাস মিনাত তারিখ (১৯৫৭), কাসাস মিনাল হায়াত (১৯৫৯), মাআন নাস (১৯৬০) মাকালাত ফি কালিমাত (১৯৫৯), মিন হাদিসিন নাফস (১৯৬০), হুতাফুল মাজদি (১৯৬০) শেষ বয়সে আলী তানতাবী শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। হাসপাতাল আর বাসায় অনেক বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে হয় তাকে। মৃত্যুর বছর যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৯ সাল। ১৪ রােজ শুক্রবার এই মহা মনীষী জেদ্দার বাদশা ফাহাদ হাসপাতালে পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে পরকালের অনন্ত পথে পাড়ি জমান। পরের দিন মসজিদুল হারামে জানাযা শেষে মক্কাতুল মুকাররমার কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।