“মুক্তি-যুদ্ধে ভারতীয় কৃষক” বইয়ের ভূমিকা:
পলাশীর যুদ্ধের পর হইতে ভারতের স্বাধীনতা-সূর্য ডুবিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কিন্তু পরাধীন ভারতের চিরবিদ্রোহী জনসাধারণ, ভারতের কৃষক, কোনােদিনই বিদেশি ইংরেজ শাসনকে মানিয়া লয় নাই। তাহারা প্রথম হইতেই বারংবার সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদের প্রয়াস পাইয়াছে। সেই সশস্ত্র বিদ্রোহের কাহিনী লইয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে বিদ্রোহী ভারতের এক অমর ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাস আমরা প্রায় ভুলিয়া গিয়াছি। ভারতবাসী যাহাতে সেই বিদ্রোহী ভারতের ইতিহাস ভুলিয়া যায় এবং ইংরেজ প্রভুদিগকেই ‘ভারতবর্ষের উদ্ধারকর্তা ও সভ্যতার পথপ্রদর্শকরূপে বরণ করিয়া লয়, সেই উদ্দেশ্যেই ইংরেজ তাহাদের প্রয়ােজনমত এক বিকৃত ইতিহাস রচনা করিয়া গিয়াছেন। সেই বিকৃত ইতিহাসে জনসাধারণের—অগণিত কৃষকের—নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের নামগন্ধও নাই। সেই ইতিহাসে ভারতের চিরবিদ্রোহী কৃষক ইতিহাসের ভারবাহী গর্দভরূপে অবহেলিত। সেই গর্দভই যে উহার পৃষ্ঠে চাপানাে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পর্বত-প্রমাণ ভার আপনাদের একক শক্তিতে বার বার ধূলিসাৎ করিবার চেষ্টা করিয়াছে, ঐ। ইতিহাসে তাহা সুকৌশলে প্রচ্ছন্ন রাখা হইয়াছে। বিদেশি শাসকগণেরই ব্যবস্থাপনায় সেই বিকৃত ইতিহাস এতকাল আমাদের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে এবং আমাদের দেশের কিশাের-কিশােরী ও তরুণ-তরুণীদিগকে তােতা পাখির মতাে মুখস্থ করানাে হইয়াছে। স্বার্থান্বেষী বিদেশিদিগের পক্ষে ইহা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেই বিকৃত ইতিহাস আজও অব্যাহতভাবে চলিতেছে। বিদেশি ইংরেজদের রচিত ইতিহাসের স্বরূপ উদঘাটিত করিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন :“ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে ছেলেয়, ভাইয়ে ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, একদল যদি বা যায়—কোথা হইতে আর এক দল। উঠিয়া পড়ে—পাঠান, মােগল, পাের্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ—সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরােত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।” “কিন্তু এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্নদৃশ্য পটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা যায় না। ভারতবাসী কোথায়, এই সকল ইতিহাস তাহার কোনাে উত্তর দেয় না।” “যে সকল দেশ ভাগ্যবান তাহারা চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজিয়া পায়, বাল্যকালে ইতিহাসই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয় সাধন করাইয়া দেয়। আমাদের ঠিক উলটা।” (ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১-৩)। এই উলটা ব্যবস্থাকেই আমরা স্বাধীনতা লাভের পরেও প্রাণপণে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছি এবং কেন ধরিয়া আছি তাহারও কারণ দুৰ্জেয় নহে। যে দেশে ১৭৫৭ হইতে ১৯৪৭ এই দীর্ঘ একশত নব্বই বৎসরকালের নিরবচ্ছিন্ন গণ-সংগ্রামের পরেও স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস রচনা সম্ভব হয় না, সে দেশে উলটা ব্যবস্থাকে সােজা ব্যবস্থা বলিয়া, মিথ্যাকেই সত্য বলিয়া আঁকড়াইয়া ধরা—সেই ইতিহাসকেই দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থ করানাে ব্যতীত আর কি উপায় থাকে? যে পণ্ডিতগণ আজীবন সংগ্রামের ক্ষেত্র হইতে বহু দূরে থাকিয়া নিজেদের গােষ্ঠী-স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়াছেন, তাঁহারাই দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস রচনার ভারপ্রাপ্ত। তাই, এই ইতিহাস রচনায় এত বিভ্রাট—তাই, তাহাদের রচিত ইতিহাসে দুইশত বৎসরের গণসংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করে না। কিন্তু কৃষিপ্রধান ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কোনােকালেই রচিত হইবে না। আশার কথা, সত্যানুসন্ধিৎসু অখ্যাত লেখকদিগের মধ্যে কেহ কেহ কৃষক-সংগ্রামের উপর যথােচিত গুরুত্ব আরােপ করিয়া এই ইতিহাস রচনায় দুঃসাহসী হইয়াছেন এবং সেই ইতিহাসই পাঠকগণের আগ্রহ আরও বর্ধিত করিতে সমর্থ হইবে।