‘কী আর হবে একটি দোষে!’ বইয়ের ভূমিকাঃ
মানব সমাজের অগ্রগতিতে সৃজনধর্মী কর্মকুশলতা কিংবা অবসর বিনোদনের অঙ্গস্বরূপ গল্পের ভূমিকা আজও অনস্বীকার্য। যুগে যুগে মানুষ বহু বিচিত্র রকমের গল্প বলেছে, শুনেছে আর লিখেছে। অনেক সময় নিটোল বাস্তব ঘটনা কাল্পনিক কাহিনি কিংবা রূপকথার রূপ পরিগ্রহ করেছে -Fact হয়ে গেছে Fiction! তবে মোটামুটিভাবে গল্পকে আমরা তিনটি ভিন্ন ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা : The myth, the fable (or parable), and the tale; তিনটি ভিন্ন ধরনের চরিত্রায়ণও এর অনুষঙ্গ। একজন লেখক সম্পর্কে কোনো বিখ্যাত সমালোচকের অনুসরণে আমরা বলতে পারি, ‘পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে মানব-মনের অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা তিনি করেননি। এখানে জীবন জেগেছে অনবদ্য বাকভঙ্গির মধ্যে। এখানকার চরম সত্য যাচ্ঞা ও ব্যর্থতার কাহিনি নয়, কিন্তু নিশ্চিন্ত সহজতায়, সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করবার বাণীবিন্যাস।’ (সৈয়দ আলী আহসান: গল্প-সংগ্রহ, ভূমিকা)।
এম মিরাজ এইচ রচিত কী আর হবে একটি দোষে আদ্যোপান্ত পড়তে গিয়ে উপর্যুক্ত কথাগুলো মনে পড়ল। এই লেখকের কোনো গল্প পত্রপত্রিকায় কিংবা বইতে আমি ইতিপূর্বে পাঠ করেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু এবার পাণ্ডুলিপিটি পড়ে আমার মনে হলো, গল্পের তিনটি ভাগের মধ্যে তাঁর গল্পগুলো পড়ে যায়। তাছাড়া, নিশ্চিন্ত সহজতায় নিজস্ব বাণীবিন্যাসে তিনি তা প্রকাশ করেছেন এ কথাও বলা যায়। গল্পগুলোতে কিংবদন্তিমূলক কাহিনি, প্রবাদসিদ্ধ Moral Story -র ছাপ রয়েছে। এতে যেমন নতুনত্ব আছে তেমনি মানুষের অনন্য কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে।
বইয়ের প্রথম গল্প “রক্তদানের পুণ্য” তন্ময় নামের এক আদর্শবাদী সরল তরুণের বড়ো হয়ে উঠার গল্প। শিক্ষণীয় বিষয় সহজভাবে বলা। “ভার তো অইলো” গল্পে একটু বোকা প্রকৃতির মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনি। বিপরীত দিক থেকে নির্মম মানসিকতার আব্বাসের মনে “মনুষ্যবোধের” উদয় আকস্মিকতার সঞ্চার করে।
কিংবদন্তিমূলক কাহিনি “কী আর হবে একটি দোষে” আমরা মানুষ বিক্রির হাটের সন্ধান পাই। বেশি দাম দিয়ে যে চৌকষ ভৃত্য সেখান থেকে কিনলেন রাজা মশাই তার ৯৯ভাগ ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও সবশেষে একটি দোষের জন্য তাঁর সর্বনাশ ঘটে গেল। অবিশ্বাস্য এক ঘটনায় আমরা দেখি নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা।
“অতি লোভে তাঁতি নষ্ট”-ও একই ধরনের কাহিনি যা চলতি নাগরিক জীবনের ঘটনা প্রবাহ থেকে সংকলিত। গল্পের ভেতর গল্প তৈরি করে লেখক এখানে কাহিনির নবতর বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছেন।
“ডাক্তারের বদলে লাশ” গল্পে আমরা যাপিত জীবনের এক ট্রাজিক বাস্তবতার সম্মুখীন হই।
“ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয় (না)” গল্পের নায়ক মানিকসহ আট ভাই-বোনের সংসারের জটিল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রায় এক উপন্যাসের ব্যাপ্তিতে গড়া গল্পটিতে মানসিক প্রশান্তি লাভের উপায় নির্দেশ করা হয়েছে।
“কী হয়ে গেলো”-তে সাম্প্রতিক জনজীবনে মোবাইল ব্যবহারের যে সমস্যা তার সমাধানের একটা উপায় নির্ধারণের চেষ্টা রয়েছে।
“মাতব্বরি সমাচার” সমকালীন সমাজকাঠামোয় পুরুষদের একটি সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত রয়েছে। পারিবারিক সম্প্রীতি, বিশেষ করে ভ্রাতৃস্নেহের একটি অনবদ্য চিত্র এখানে আমরা পাই। তাছাড়া, মাতব্বরি চিত্রের প্রহসনও তুলে ধরা হয়েছে গল্পটিতে।
“রুমমেট”-এ আমরা আবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি উদ্ঘাটিত হতে দেখি। একই মুদ্রার দু’পিঠ-অকৃতজ্ঞ বনাম স্বার্থপর মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে সারগর্ভ বক্তব্য প্রকাশ করে জীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য বিষয়ে লেখক সারকথা প্রকাশ করেন।
“ঈদের জুতা” এক কৈশোরিক কাহিনি। তবে মানবিক ভাবনা সমৃদ্ধ।
“অকর্মণ্য উপদেশের পরিণতি” প্রবাদসিদ্ধ বাস্তবতার স্বরূপ প্রকাশ করে।
সংক্ষেপে এম মিরাজ এইচের গল্প সংগ্রহের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো। ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি ও কাহিনি নির্মাণে তাঁর নিষ্ঠা উত্তরোত্তর আমাদের কথাসাহিত্যের সমৃদ্ধ পটভূমিতে স্থায়ী আসন লাভ করবে, এমন আশা ব্যক্ত করা যায়।
প্রফেসর ডক্টর মাহমুদ শাহ কোরেশী
সাবেক মহাপরিচালক
বাংলা একাডেমি (একুশে পদকপ্রাপ্ত)