“জীবন বহে নিরবধি” বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর একাত্তরের পরাজিত শক্তি মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মল আন্দোলন সেই ধারাকে প্রতিহত করে বইয়ে দিয়েছে জনঘৃণার নর্দমায়।
প্রথমে ‘একাত্তরের দিনগুলি’র লেখক হিসেবে পরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে নিজেকে তিনি অধিষ্ঠিত করেছেন লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, কিংবা কোন পার্থিব প্রাপ্তির আশায় নয়, শুধুমাত্র দেশপ্রেমের কারণে, দেশের মানুষকে ভালবাসার কারণে—তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশকে তিনি। আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযােগ্য করে রেখে যাওয়ার সংগ্রামে, সামগ্রিকভাবে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে তিনি সর্বোতভাবে নিয়ােজিত রেখেছিলেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। তিনি বেঁচেছিলেন পঁয়ষট্টি বছর। ‘২৯ থেকে ‘৯৪ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের রথের চাকার বহু গতিপরিবর্তন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল রূপ, উপমহাদেশের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও ভারত বিভক্তি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর তিনি দুর থেকে দেখেননি, নিজেই ছিলেন ইতিহাসের এই মহান অধ্যায়ের অন্যতম চরিত্র।
তাঁর পঁয়ষট্টি বছরের জীবনকে আমরা দু’ভাবে দেখি। প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে, যে জীবন ছিল একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব, রুচিশােভন, পরিশীলিত এক আনন্দের জগৎ। তখন তার প্রধান পরিচয় ছিল লেখক ও সমাজসেবক। লেখালেখি শুরু করেছিলেন শিশু কিশােরদের জন্য। পরে লিখেছেন বড়দের জন্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাকে নির্বাসিত করেছে পরিপূর্ণ আনন্দের এই সপ্রেম জীবন। থেকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তিরিশ লক্ষ মানুষ, জাহানারা ইমাম হারিয়েছেন তাঁর পুত্র এবং স্বামীকে। একাত্তরের পর শুরু হয়েছে এই তার জীবনের সেই গৌরবময় অধ্যায়, যা তাঁকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত প্রতীকে। মৃত্যুর আগে তিনি আত্মজীবনী লেখা আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তার অগ্রন্থিত অপ্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘জীবন বহে নিরবধি’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হল।
শাহরিয়ার কবির।