স্বদেশ থেকে উন্মলিত ও সর্বার্থে বিপন্ন একজন মানুষের সামনে পায়ের নিচে একটুখানি মাটি পাওয়ার সুযােগ। আসা সত্ত্বেও কেউ যখন তা গ্রহণ না করেন, তখন। হিসেবি লােকদের কাছে তাকে বেহিসেবি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মনুষ্য-সমাজে সংখ্যায় নগণ্য হলেও এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা ওই ‘স্বাভাবিকতা’ বহির্ভূত । সাদত হাসান মান্টো সেই ব্যতিক্রমীদের একজন । ক্ষতাক্ত স্বাধীন ভারতের দুই অঞ্চলেই তখন মুহাজির-অমুহাজির উভয় শ্রেণির বহু মানুষের মধ্যে চলছিল জমি-দোকানপাট-কলকারখানা দখলের কাড়াকাড়ি। মান্টোকে বলা হলেও এই কাড়াকাড়িতে তাঁর মন সায় দেয়নি। তারপর সুযােগ আসে একেকটা। লেখার বিনিময়ে পাঁচশাে করে রুপি পাওয়ার। মান্টো তখন নিঃসীম দারিদ্র্যে দিশেহারা। পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের কোনাে ব্যবস্থা নেই। অথচ সুযােগটা তিনি গ্রহণ করলেন না। নাকি করলেন? বিচারের ভার। পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়ে শুধু ঘটনাটা বিবৃত করা যাক। বিশ্বমােড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি প্রতিষ্ঠান। ইউনাইটেড স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিস। একদিন লাহাের অফিসের এক কর্তা মিস্টার স্মিথ মান্টোর ডেরায় এসে প্রস্তাব দিলেন তাদের ম্যাগাজিনে তিনি যেন কিছু লেখা দেন। প্রতিটি লেখার দক্ষিণা পাচশাে রুপি। মান্টো দুশাের বেশি নেবেন না। ঝলোবালির পর রফা হলাে তিনশাে রুপিতে। মান্টো তার লেখায় গ্রহণ করলেন চিঠির ফর্ম। কোনাে এক স্যাম চাচাকে সম্বােধন করে লেখা সেই চিঠি।
স্যাম চাচা ঠিক অনির্দিষ্ট কোনাে একজন লােক নয় । রক্ত-মাংসের বাস্তব মানুষ। নাম স্যামুয়েল উইলসন, মােড়ক-দেওয়া মাংস বিক্রেতা। বিশ্বযুদ্ধ তাকে বিখ্যাত করে তােলে। এমনকি মার্কিন সরকারের কাছেও মান্টো। প্রথম যে-লেখাটি খামে ভরে মার্কিন দপ্তরে নিয়ে গেলেন তা। ওই আঙ্কেল স্যাম বা স্যাম চাচাকে লেখা একটা চিঠি। ওই চিঠিতে মান্টো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখােশ উন্মােচন করেছেন। দেখিয়েছেন তথাকথিত সভ্যতার আড়ালে। দাঁত-নখ বের-করা এক বীভৎস রূপ । স্যাম চাচা হয়ে যায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক। এরপর মান্টো তাকে আরও আটটি চিঠি লেখেন। কী বলা যাবে একে? পাগলামি, না ত্যাড়ামি? চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও নিজের শিল্পীসত্তাকে মরতে না দিতে ক-জন পারেন! । বাংলা অনুবাদে মান্টোর চিঠিগুলাে পড়ার সুযােগ। বাংলাদেশের পাঠকেরা বােধকরি এই প্রথম পেলেন। যারা এই বিরল মানুষটিকে জানেন তারা চিঠিগুলাে থেকে। মান্টোর ভিন্ন এক সত্তার পরিচয় পাবেন আশা করি ।