ইতিহাস একটি আয়না, যার সামনে দাঁড়ালে আমরা নিজেদের দেখতে পাই। ইতিহাস বরাবরই রচনা করে বিজয়ী হাত। পরাজিতরা নিজেদের ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। তারা যখন সেটা পারে, তখন আর পরাজিত থাকে না। কবি, গবেষক মুসা আল হাফিজ বরাবরই তাদের মুখে ভাষা তুলে দেন, যাদের বিজয়ী হওয়া উচিত, কিন্তু পরাজিত হয়ে আছে। তাদের হারানো সত্যকে আবিষ্কার করে তাদের হাতে তুলে দেন। যেন নিজেদের তারা খোঁজে পায়। এদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাদের সাধনা ছিলো, ঘাম ও রক্ত ছিলো, তারাই যখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে চিত্রিত হয়, তখন সঙ্গতকারণে মুসা আল হাফিজের সত্যসন্ধানী মনে ঢেউ তৈরী হয়। এরই ফসল কত সমৃদ্ধ হতে পারে, তার নমুনা মুক্তিযুদ্ধ ও জমিয়ত: জ্যোতির্ময় অধ্যায়।
বিশাল আকারের বই নয় এটি। কিন্তু এর ভেতরে নিহিত আছে বিশাল পালাবদল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজমানস ও ইতিহাসকে ধরে সবলে টান মারে এ বই। এ টান এতো শক্তিশালী, যা ওলট-পালট করে দিতে চায় এতোদিনের সাজানো চিত্রকল্প। প্রতিষ্ঠিত করে তাকে, যাকে পদদলিত করা হচ্ছে। ভাষা তুলে দেয় তার মুখে, যে ভাষা হারিয়েছে। বিজয়ের শক্তি সরবরাহ করে তাকে, যাকে জোর করে পরাজিত করে রাখা হয়েছে। অনস্বীকার্য তথ্য ও প্রমাণের মাধ্যমে এই গ্রন্থ সাব্যস্থ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম প্রধান শক্তি হচ্ছেন এদেশের ইসলামী ব্যক্তিবর্গ, আলেম-উলামা। মুক্তিযুদ্ধকালে যাদের প্রতিনিধিত্ব করতো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।
এ বইয়ের মাধ্যমে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দলগতভাবে এবং উলামায়ে কেরাম সমষ্ঠিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এতোকাল ধরে যে সত্য ছিলো সবার অগোচরে। উল্টো বরং নাটক,উপন্যাস, গল্প থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বক্তৃতাসহ সব জায়গায় মুসলিমদের পোশাক, দাড়ি,টুপি ইত্যাদিকে রাজাকারের চরিত্রে যুক্ত করে দিয়ে বুঝানো হয়েছে ইসলামভাবাপন্ন মানুষেরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। এর মাধ্যমে তাদেরকে জাতীয় শত্রু হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
এ বইয়ে বিবৃত সত্যকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখানে শোনা কথার ভিত্তিতে ইতিহাস লেখা হয়নি কিংবা বিভিন্নজনের মৌখিক দাবিকে দলিল হিসেবে পেশ করা হয়নি। বরং এমন সব প্রমাণ এখানে উপস্থাপিত, যাকে খারিজ করা অসম্ভব। ফলে এ গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে আশা করাই যায়। এর প্রভাব পড়বে আগামীদিনের রাজনীতিতে। এ বইয়ের প্রমাণসমূহের ভেতর নিহিত আছে এতোকাল ধরে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে অপরাজনীতির প্রতিরোধের সূত্র। একে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলে আলেম- উলামাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আখ্যায়িত করার তৎপরতাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আগামীদিনের ইসলামী রাজনীতির পথনির্দেশে এ বই গুরুত্বপূর্ণ । একজন দরদী ও দায়িত্বশীল গবেষক হিসেবে মুসা আল হাফিজ খুবই সূক্ষ্মভাবে ইসলামী রাজনীতির ধরণ ও চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, সেটা দেখাতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি স্বাধীনতাপূর্ব জমিয়তের রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, দলীয় দাবিদাওয়া, দৃষ্টিভঙ্গি, ময়দানী তৎপরতা ইত্যাদির পর্যালোনা করে ইশারা করেছেন, ইসলামপন্থীদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে কমতি আসলে কোথায়? বইটির দাবি হচ্ছে,মানুষের জীবন- জীবিকা এবং দেশ ও জাতির সামগ্রিক সমস্যা- সঙ্কট নিয়ে গণমুখী ও গণপ্রতিনিত্বমূলক রাজনীতি । এরই সাথে উম্মাহের ঐক্য ও কল্যাণ,তাহযিব- তামাদ্দুনের সুরক্ষা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে সত্য, সুন্দর ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। দল হিসেবে জমিয়তের জন্য এ বই একটি গৌরবময় মাইলফলক। কারণ এর দ্বারা দলটি জাতিরাষ্ট্রে নিজেদের দান ও অবস্থান জানতে পারবে, জানাতে পারবে। নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে জাতীয় রাজনীতিতে আরো প্রাসঙ্গিক করতে পারবে।
কিন্তু বইটি আসলে সবার জন্যই। যারাই মুক্তিযুদ্ধকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে চান, চাপিয়ে দেয়া বয়ানের বাইরে গিয়ে সত্য তালাশ করতে চান, তাদের জন্য এ বই একটি নবআবিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকার অনুসন্ধানী গ্রন্থ হিসেবে এর গুরুত্ব ব্যাপক। বইটি সর্বমহলে বহুল পঠিত হোক, আলোচিত হোক। কারণ এর সাথে আমাদের দৃষ্টির উন্মোচন ও মানসিকতার প্রসারের সম্পর্ক রয়েছে।