“মৌসুমী সমুদ্রের উপকূল
মগ ও পোর্তুগিজদের দৌরাত্ম্যে বিপর্যস্ত-বাংলার শোকগাথা যেন এই উপন্যাস। আউলকেশী,ইগনেশিয়াস ডি সিলভা, কবিরাজ ক্ষেমংকর সেন, উপকূলের বণিক যুগল সাধু, মিরবহর জাহাঙ্গীর ইউসুফ, মারিয়া ল্যাবার্ডো, ওলন্দাজ বণিক ইয়েকব, পর্তুগিজ বণিক মাসকারহেনা, এ ধরনের অসংখ্য চরিত্র সতেরো শতকের বাংলা উপকূলে বসবাস করছে। তৈরী হচ্ছে নানা ধরনের নাটকীয় সংঘাত, ট্রাজেডি। ধাত্রীনগর গ্রামে মগ আক্রমণকে কেন্দ্র করে লেখক এক বিস্মৃত সময়ের আখ্যান রচনা করেছেন, যার পরিধিতে ষোলো-সতেরো শতকের ইউরোপ থেকে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ-সন্দীপ-আরাকান-চট্টগ্রাম একসূত্রে ধরা পড়েছে।
বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর
“”নদী গ্রামটাকে ঘিরেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে।উত্তরে এলুয়ার দহ, গভীর এবং ভয়ঙ্কর। সেখানে তিসলি মাশনার রাজত্ব।দক্ষিণের ঘাট থেকে বালা লখিন্দর যখন বিদ্যাকে নিয়ে নৌকায় উঠল, তখন রাত আন্দাজ দশটা হবে। কবিরাজ এর ঘন্টা দুয়েক আগে মারা গেছে।
অমাবস্যা পক্ষের চতুর্থী কি পঞ্চমী তিথি। বেশ কিছুটা ক্ষয পাওয়া চাঁদ উঠে এসেছে একটু আগে। নদীর বুকের ক্রমশ বেড়ে ওঠা বালিয়াড়ি এবং শীতের প্রায় নিষ্প্রাণ-প্রবাহ সত্ত্বেও নদী এলুয়াতে খুব সংক্ষিপ্ত নয়। সামনে যে দহ আছে, তাতে বিস্তর জল, ফলে সমস্ত গ্রামটি ঘিরে নদীর বিস্তার এই পৌষের শীতেও কম নয়।
বালার নৌকাটা আসলে দশ-বারো হাত লম্বা একখানা জেলে ডিঙি। নৌকা এখান থেকে এলুয়ার দহ-তে পড়বে প্রায় পুরো গ্রামটাকে ঘুরে। গ্রামকে ঘিরে নদীর মাইল তিনেকের বাঁক। এলুয়ার দহের জল তো শুধু মানুষেরই নয়! বালার ভয় আপাতত সেটাই। কিন্তু করারও কিছু ছিল না তার। কাজেই মানুষ কিংবা তিসলি, কোনো কিছুতেই তার ভয় পেলে চলবে না, এ-কথা সে বুঝেছিল। ভারি উত্তেজিত ছিল সে। দেড় বছরের যন্ত্রণাময় অপেক্ষার অবসান হয়েছে তার। দহ পেরিয়ে বিদ্যাকে নিয়ে কেশবপুরে যাচ্ছিল সে।
বালা খুবই সন্ত্রস্ত আর বিদ্যা ছিল একেবারে বিধ্বস্ত। কবিরাজ গুণমানের শেষ কয়েকটি দিন সত্যিই মারাত্মক ছিল তার কাছে। বিশ্রাম, ঘুম, খাওয়া কোনো কিছুই তার হিসেবের মধ্যে ছিল না। সাহায্য করার মধ্যে ছিল একমাত্র নিশি, বিদ্যাকে দেখাশোনা করার জন্য কবিরাজ যাকে নিযুক্ত করেছিল। ডিঙি নৌকাখানার পাটাতন বাঁশের ছিলা চেঁছে তৈরি। বিদ্যা কোনোরকমে তার উপরে জবুথবু হয়ে বসেছিল। তার শরীরে এক আশ্চর্য অবসাদ নেমে এসেছে এতক্ষণে। জ্যোৎস্নালোকিত আকাশ থেকে তীব্র শীত নেমে আসছিল। একখানা মোটা কাঁথা দিয়ে মাথা এবং দেহ ঢাকা বিদ্যার। কিন্তু তাতে শীত মানছে না। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যে স্নায়বিক চাপের মধ্যে সে ছিল, তাতে তার শীতও তেমন করে বোধ হয়নি। এতক্ষণে মনে হলো, ভিতরের বস্ত্র পর্যন্ত হিমে ভিজে যাচ্ছে। ডিঙির মাঝখানে বসে সে হাত দিয়ে হাঁচু থেকে পা পর্যন্ত জড়িয়ে থাকা ভিজে বালি ঝাড়ল। অন্তত দেড় মাইল রাস্তা এই হিমশীতল বালির ওপর দিয়ে বালার হাত ধরে দৌড়ে আসতে হয়েছে তাকে। মাথার ঢাকার ফাঁক দিয়ে সে একবার বালার দিকে তাকাল। দীর্ঘাকৃতি পুরুষটি দাঁড়িয়ে লগি ঠেলে ডিঙি নৌকাখানাকে গভীরতর জলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ডানদিকের ঘাড় থেকে মোটা খদ্দরের চাদরখানা তার পা অবধি ঝুলে পড়েছে। সে যেখানে দাঁড়িয়েছে, ডিঙির সেই গলুই অংশটি শরীরের ভারে জলের একেবারে সমতলে। ফলে নৌকার অন্য মাথা সামনের দিকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। পরিশ্রান্ত এবং দৃঢ় শ্বাস টেনে টেনে বালা নৌকাখানাকে সামনের দিকে ঠেলছিল। চাঁদের আলোয় এই অপার্থিব মুহূর্তে হঠাৎ তাকে দৈবপুরুষের মতো মনে হলো বিদ্যার। সে মুগ্ধ হয়ে তাকাল তার পুরুষটির দিকে। একসময় তার দৃষ্টিপথে বালার মাথা ছাড়িয়ে গাছের দীর্ঘসারিকে জেগে উঠতে দেখা গেল। দক্ষিণের খাড়া পাড়ের গাছের সারি আকাশের দিকে উঠে গেছে। নদীর গভীরতা দক্ষিণের পাড় ঘেঁষেই। পাড়ের উঁচু বাঁধের সীমানা ছাড়িয়ে বিদ্যা তার নজর ক্রমশ উপরের দিকে ছড়িয়ে দিল। চারদিকের গাছগুলো যেন নদীর জলের মধ্যে ঝুঁকে তাদের দেখছে। সেইসব গাছদের মাথা ছুঁই-ছুঁই বালা লখিন্দরের মাথা। চারদিকের স্তব্ধ গভীর রাতের নদী-মধ্যকার অপরিচিত নিসর্গ বিদ্যাধরীকে কেমন বিহ্বল করে দিল। কতকাল আগে সে যেন ভেসেছিল আরেকবার? সে কত জন্ম আগে? সে কি এই মানুষের সঙ্গে? মাছ, মকর, ঘড়িয়াল-কুমীর, পালে পালে শিশুমার ধেয়ে এসেছিল যে পচনধরা দেহটির লোভে, সে কি ওই দিব্যপুরুষটির! যার মাথা এই মুহূর্তে গাছপালা ছাড়িয়ে নক্ষত্রের গায়ে গিয়ে ঠেকছে! ভয়, হতাশা, হাজার প্রলোভন জয় করেছিল কি বিদ্যা এই পুরুষের পথ চেয়েই? জয় মা বিষহরি! আমার চাঁদের সাম্পানের কাণ্ডারী তোরই সন্তান, মা! তাকে দেখিস মা!””
বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর
দুটি উপন্যাস
অভিজিৎ সেন
প্রচ্ছদঃ শুভশ্রী দাস”