রাজনীতি বোধহয় সব পারে, সব পেরেছে– রাজনীতির গোলক ধাঁধায় বিপন্ন হতে পারে গ্রাম, শহর, লোকালয়; এমনকি সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা। রাজনীতির মানবিক জ্যোৎস্নায় কেঁপে উঠতে পারে মরাগাঙ। এই রাজনীতিই একদিন বিধ্বস্ত করেছে আমাদের শ্যামল ছায়া, জ্যোৎস্না রাত, আকাশের নীলিমা। বিপন্ন করেছে আমাদের পূর্বপুরুষদের উদ্বেগহীন ও আনন্দময় জীবন; সংকটাপন্ন করেছে আমাদের আত্মপরিচয়। আবার রাজনীতির পথ ধরেই আমরা ফিরে এসেছি মা-মাটি-মানুষের কাছে; চিরায়ত বাংলাদেশের কাছে। ১৯৪৭-এর ভ্রান্ত রাজনীতি বাঙালি মুসলমানকে করেছে উদ্বাস্তু, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। চেয়েছে তার মহৎ ভাবনাগুলো উপড়ে ফেলতে। কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের জ্যোৎস্না ধোয়া মানবিক রাজনীতির পরশে জেগে ওঠে আদিগন্ত কাদামাটিতে লেপটানো বাঙালি মুসলমান। সন্ধান পায় এক নতুন পথের। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার সীমা পেরিয়ে সে আকাশ ছুঁতে চায়। নতুন করে জেনে নেয় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও বাঙালি আধুনিকদের। তার চিত্তে ফুটে উঠতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতির মহৎ ভাবনাগুলো ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও রবীন্দ্র-নজরুলের গানে, কবিতার পঙ্ক্তিমালায়, মননচর্চা ও সম্প্রীতি সাধনায় পূর্ববাংলার গ্রাম ও শহর মুখর হয়ে উঠতে থাকে। সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তি আত্মায় ধারণ করে বাঙালি মুসলমান এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ইতিহাসের পাতা ফুঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের। নতুনভাবে জন্মলাভ করে বাঙালি মুসলমান। স্বাধীনতা পাই আমরা, কিন্তু দাঁড়াতে পারিনি আদর্শিকভাবে। যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়, তা কি ব্যর্থ হতে চলেছে? বাঙালি মুসলমান কি পথ হারিয়ে ফেলবে অসহিষ্ণুতা, ভ্রান্তির ঘোর আঁধারে? তার চৈতন্য কি আলোড়িত হবে না মাটি ও আকাশের গানে? এ সবই মেলে ধরেছেন আবদুল্লাহ আল আমিন তার ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি-ভাবনা’ গ্রন্থে।