গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার (খ্রি.পূ. ৩৫৬—৩২৩) দার্শনিক ডায়োজেনিসকে দেখতে গেলেন। তিনি তখন নিজের আস্তানায় বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন একা। আলেকজান্ডার কাছে গিয়ে তাকে বললেন, ডায়োজেনিস! আমি আপনার জন্য কীর করতে পারি? তখনকার দুনিয়ার সেরা নৃপতি এসেছেন সহযোগিতা করতে। ডায়োজেনিস তার কাছে চাইলেন বটে সহযোগিতা! বললেন, ‘তুমি আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াও! কারণ তুমি সামনে দাঁড়িয়ে আছো বলে আমার আলোকস্নান বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ডায়োজেনিসদের দরকার রোদ, আলো, একে আড়াল করে যদি আলেকজান্ডারও দাঁড়ান, তারা বলবেন, সরো তো বাপু!’ যেকোনো সুযোগ—সহযোগিতার প্রস্তাবকে তারা এর বিনিময়ে পাত্তাই দেন না। এই যে স্বচ্ছ আলো, সেটা ব্যক্তি মানুষের যতোটা দরকার, জাতীয় মনন ও দৃষ্টির জন্য আরো বেশি দরকার। কিন্তু জাতীয় মনন ও দৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় আলোকলাভের পথে অনেক সময় দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিবিধ বয়ান ও ভাবধারা। সেই সব বয়ান ও ভাবধারা যদি ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে সেটা শুধু অস্বাস্থ্যকর নয়, বিপজ্জনক। কারণ এতে জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের উপর তৈরি হয়। অস্পষ্টতার প্রলেপ। অনেক সময় সেটা কেবল অস্পষ্টতায় থেমে থাকে না, অন্ধকারে পরিণত হয়। এদেশে, আমাদের আত্মপরিচয় এমন অস্পষ্টতা বা অন্ধকারের কবলে পড়েনি, তা বলার সযোগ নেই। সেই আবরণ ক্ষমতা সম্পর্কের পাটাতনে দাঁড়িয়ে রাজকীয় অবয়বে আমাদের পরিচয়ের ভাষ্য নির্ধারণ করে আমাদের ‘সহায়তা’ করতে চায়। ‘বাংলাদেশ ও ইসলাম : আত্মপরিচয়ের ডিসকোর্স’ আরোপিত কোনো রাজকীয় ভার্ষ দিয়ে নিজের পরিচয় নির্মাণের সহায়তা নিতে রাজী নয়। বইটি বরং স্বচ্ছ আলোর অবগাহনে সচেষ্ট। এজন্যে সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অধিপতি বুদ্ধিবৃত্তির ভাষা ও ভাষ্যকে হেলাচ্ছলে বইটি বলে, ‘সরো তা বাপু।’ আমার আলোর দরকার।’ এ বই ইতিহাসের গভীর থেকে আমাদের আত্মপরিচয়ে একটি প্রচেষ্টা। যা, ইতোপূর্বে হাজির করা অধিপতি বয়ান থেকে আলাদা। সন্ধানের বইটিতে বিদ্যমান প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময়ের রচনা। ফলে পুনরোক্তি থাকতে পারে কোথাও। সবগুলো প্রবন্ধ শেষ অবধি সরাসরি সত্যালোকে নিজেকে পুড়াতে চেয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে পেয়েছে আত্মপরিচয়ের সেই ডিসকোর্স, যাকে আমরা বহন করছি মনে, রক্তে, সত্তায়!