বাঙ্গালা গবেষণা বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৪ বাঙ্গালা গবেষণা বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৪ এ সংকলিত প্রথম গ্রন্থটি হলো পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি দ্বিতীয় খণ্ড। উল্লেখ্য, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থের তিনটি খণ্ড রয়েছে। রচনাবলীতে রচনা প্রকাশের কালক্রম রক্ষা করা হচ্ছে বিধায় এই তিন খণ্ড খণ্ডক্রমে নয়, কালক্রমে মুদ্রিত হবে। এ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডটি ‘বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ কেন সে বিষয়ে উমর লিখেছেন, “এ বইটির তিনখণ্ডের মধ্যে এই দ্বিতীয় খণ্ডটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এই খণ্ডেই আমি তৎকালীন পূর্ব বাঙলার গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতিসহ অন্য কয়েকটি বিষয়ে যে আলোচনা করেছি এবং যে সব ঘটনার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছি সেগুলির সাথে পরিচয় ব্যতীত ভাষা আন্দোলন কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়ে এক বিশাল জাতীয় গণপ্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিলো সেটা বোঝা সম্ভব নয়।” (‘দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ’:উর:৪:৭)(বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী : খণ্ড ৪ : পৃষ্ঠা ৭) আলোচ্য দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদ হলো যথাক্রমে ‘পূর্ব বাঙলার দুর্ভিক্ষ’, ‘পূর্ব বাঙলার জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ এবং ‘পূর্ব বাঙলার কৃষক আন্দোলন’। এই পরিচ্ছেদ তিনটি সম্পর্কে উমর লিখেছেন, “এই খণ্ডের প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সর্বশেষ পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার কৃষকদের অবস্থা প্রসঙ্গত বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনার সাথে আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক-এর বিবরণ ও আলোচনার একটা ধারাবাহিকতা আছে। এজন্যে এই তিনটি পরিচ্ছেদকে উপরোক্ত বইটির দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।” (প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ:উর:৪:৯) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক গ্রন্থে উমর লিখেছেন, ‘মোগল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্ব ভোগীর কোন স্থান ছিলো না’, ‘বংশানুক্রমিক জমিদারী’ ছিলো না, তখন জমিদার ছিলো ‘সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেণ্ট মাত্র, ভূস্বামী অথবা জমির মালিক নয়।’ (উর:২:৩৩৭) তখন জমির মালিক ছিলো কৃষক, ‘জমির সত্যিকার মালিক তখন ছিলো তারাই যারা নিজেরা গ্রামে কৃষিকার্যের দ্বারা জমিতে ফসল উৎপাদন করতো।’ (ঐ) কৃষক ছিল স্বাধীন, জমির মালিক। জমির মালিক কৃষক হলেও সরকার তরফে সে পেত খরা-ভর্তুকি, সেচ সুবিধা, জলপথে পরিবহনের সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলের অনুদান, লাখেরাজ সম্পত্তির সুবিধা – লেখাপড়া-গবেষণা-শরীরচর্চা-ভ্রমণ-ধর্ম-সংস্কৃতি চর্চার সুবিধা। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে পাল্টে দিল। এখন জমিদার হলো জমির মালিক ও স্বত্বাধিকারী; সে খাজনা আদায় করবে যার ‘নয়-দশমাংশ’ প্রভুকে দেবে। তার এক্তিয়ারে গেল ‘যথেচ্ছ’ আদায় – এক্তিয়ার গড়াল জমি ক্রয়বিক্রয়, বিলিব্যবস্থা, পত্তনীস্বত্বদান, ভূমিদাস-জলদাস রাখা, বারো মাসের তেরো পার্বনে তোলা তোলা; প্রয়োজনে সে কৃষককে শাস্তি দিতে পারবে, তার সাতক্ষুণ মাফ। কৃষকের সমস্যায়-খরায়-বন্যায়-সেচে-ভূমি উন্নয়নে সাম্রাজ্যবাদ ভূমিকা নিল না, জমিদার রইল উদাসীন। তবে কৃষক দমনে আর শোষণে তারা রইল একসাথে, সাথে থাকল মধ্যশ্রেণী-কেরানীকুল। এরা সবাই মিলে কৃষককে জমিহারা, তাঁতীকে টাকুছাড়া, জেলেকে জালজলা ছাড়া করল। বর্বরতার সাথে লুণ্ঠন শুরু করল। সে শোষণ আর লুণ্ঠন এমনই যে, ছিয়াত্তরের (১১৭৬ সন/১৭৬৯ সাল) “মহাদুর্ভিক্ষে” বাংলায় ১ কোটি (বাঙলার মানুষের “এক তৃতীয়াংশ”, হেস্টিংসের পত্র) এবং বিহারে ৩০ লক্ষ কৃষকের মৃত্যু হয়। উমর লিখেছেন, মহাদুর্ভিক্ষের সাথে “অনাবৃষ্টি অথবা ঐ ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিলো না।” (উর:২:৩৩৮)। প্রত্যক্ষদর্শী ইয়ং হাজব্যান্ড এর উদ্ধৃতি দিয়ে এ মহাদুর্ভিক্ষের কারণ জানিয়েছেন উমর, “দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতি” (ঐ:৩৩৯)। এর পর ১৮০২ থেকে ১৮৫৪ পর্যন্ত ৫৩ বৎসরে প্রায় ৫০ লক্ষ; ১৮৫৪ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত ৪৭ বৎসরে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ ২৫ হাজার (সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ২য় র্যাডিকেল সংস্করণ, ২০১৮, পৃ ১৭৭-১৭৯) এবং ১৩৫০ সনে (১৯৪৩ সালে) ৩০ লক্ষ (অমর্ত্য সেন, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ, অনুবাদ কবির চৌধুরী, ২০২০, পৃ ১৭৫) কৃষক দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেন অর্থাৎ শহীদ হন। প্রকৃত গণনায় এই মৃত্যুর মিছিল আরও বৃহদাকার হবে। উপরে বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদের ‘মনোবৃত্তি’ পূরণ এবং ‘দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতা’ সম্পাদিত হয় প্রথমে ১ শালা, ৫ শালা ও ১০ শালা বন্দোবস্ত এবং পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এদেশে এই দুই শক্তির সৃষ্ট চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষে একুনে মৃত্যুর তথা হত্যার সংখ্যা ৪ কোটি ৯৮ লক্ষ ২৫ হাজার – ১৯০ বৎসরে – গড় সংখ্যায়ন করলে দাঁড়ায় বাৎসরিক ২৬২২৩৭ জন, মাসিক ২১৮৫৩ জন এবং দৈনিক ৭২৮ জন কৃষক হত্যা! পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের দুর্ভিক্ষ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত দুর্ভিক্ষের অংশ। অন্যদিকে এ সময়কালে নানকার-টঙ্কদার-লেভী-তেভাগা আন্দোলন তথা জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনও কৃষকদের ‘নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহ’ এর অংশ। পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম তিন পরিচ্ছেদে বিস্তৃতভাবে এ তিন বিষয় আলোচিত হয়েছে। দুর্ভিক্ষজনিত হত্যার সাথে যুক্ত করা যেতে পারে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী লড়াইএ সিরাজ, টিপু সুলতান সহ তীতুমীর (১৮৩১)-সিধু-কানুর (১৮৫৬) যুদ্ধ, প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৮৫৭) এবং ছোট-বড়ো আরও শতাধিক বিদ্রোহ-যুদ্ধে শহীদ কৃষক ও কৃষকনেতাদের সংখ্যা, যা হবে আনুমানিক কয়েক লক্ষ। সাম্রাজ্যবাদ ও তার স্তম্ভ, ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, দুর্ভিক্ষ শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০ বৎসর যাবৎ যুদ্ধ করেছিলো কৃষকেরা – উমর লিখেছেন, “বস্তুতপক্ষে এই দীর্ঘকালব্যাপী বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মর্মবস্তুই হলো কৃষকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহ এবং জমির উপর তার স্বত্ব পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।” (উর:২:৩৫১) উপরে বর্ণিত শোষণ শাসন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ-সংগ্রাম-বিদ্রোহ – এই দুই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় উমর আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে উপস্থাপন করেছেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই পটভূমিতেই আলোচ্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল একদিকে জমিদার ও মধ্যশ্রেণী অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষক ও চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষ। পরস্পর সম্পৃক্ত এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশ। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে তারা ভারত ছাড়ে, রেখে যায় তাবেদার শ্রেণী। পাকিস্তানের ‘সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার’ গোষ্ঠী জমিদার-মীরাসদার-জোতদার-টঙ্কদার-নানকার এবং তাদের পোষ্য মধ্যশ্রেণী কর্তৃক জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত (১৯৫০) চেষ্টা করা হয়েছে তা টিকিয়ে রাখার জন্য। কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এতদাঞ্চলের কৃষক-ভূমিহীন-ক্ষেতমজুর-ভূমিদাস-জলদাস শ্রেণী যে আন্দোলন-সংগ্রাম-সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে (১৯৪৭-১৯৫০) সেই রক্তদান অধ্যায় এপ্রথা উচ্ছেদে বাধ্য করেছে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের ভেতর স্বাধিকারবোধ উজ্জীবিত করেছে। ‘সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার’ গোষ্ঠী পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী পূর্ব বাঙলার উপর জাতিগত নিপীড়ন, স্বৈরতন্ত্র, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, আর্থিক বৈষম্য, শোষণ ও হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ নগ্নভাবে চাপিয়ে দিল। তারা বৃটিশ নীতি অনুসরণে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের হোলি খেলা করল; শুরু করল ছাত্র-সাংবাদিক-রাজনীতিক-সচেতন মানুষের মৌলিক অধিকার-বাক স্বাধীনতার উপর জুলুম; আর শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি কমিটির সুপারিশে পূর্ব বাঙলার ন্যায্য গণতান্ত্রিক, জাতিগত ও ভাষাগত অধিকার হরণ করে উপনিবেশ বানাবার স্বপ্ন দেখল। কিন্তু পূর্ব বাঙলার কৃষক-শ্রমিক, গণতন্ত্রকামী, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, জাতীয়তাবাদী, হিন্দু-মুসলমানের মিলন-আকাক্সক্ষী সচেতন বাঙ্গালী সমাজ ‘এক বিরাট ও ব্যাপক গণআন্দোলন’, ‘এক বিশাল জাতীয় গণপ্রতিরোধ আন্দোলন’ এর মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করল, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষাগত অধিকার আদায় করল। তারা সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার শাসকশ্রেণীকে সামগ্রিক প্রত্যাখ্যানের ম্যান্ডেট দিল ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ও যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে। পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি দ্বিতীয় খণ্ডে এই সমগ্র ইতিহাস শ্রেণীদৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি আবশ্যকীয় গবেষণা কাজ। এ সময়কার ইতিহাসের বিবর্তন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উমর লিখেছেন: “১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন যে সীমিত এলাকায় ঘটেছিলো এবং আন্দোলন তখন ছাত্র শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে যেভাবে সীমাবদ্ধ ছিলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেইভাবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ না থেকে তা শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের এক ব্যাপক গণ প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে সমগ্র পূর্ব বাঙলায় এক অদৃষ্টপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ১৯৪৮ সালের আন্দোলনের সাথে ১৯৫২ সালের আন্দোলনের এই পার্থক্যকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে হলে এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে পূর্ব বাঙলার ব্যাপক জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যা কিছু ঘটেছিলো এবং তার ফলে যে পরিবর্তন সমগ্র পরিস্থিতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো তা ভালভাবে জানা দরকার। পরিস্থিতির এই বিবরণের সাথে পরিচিত হলে দেখা যাবে যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুষ্টিমেয় ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীর আন্দোলন ছিলো না, তা শুধু শিক্ষাগত অথবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনও ছিলো না। বস্তুতপক্ষে তা ছিলো পূর্ব বাঙলার ওপর সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার পাকিস্তানী শাসক শোষক শ্রেণীর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক বিরাট ও ব্যাপক গণআন্দোলন।” (প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ:উর:৪:৮) রচনাবলীর বর্তমান খণ্ডে সঙ্কলিত অন্য গ্রন্থটি হলো বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমে যে দিগন্ত উমরের চোখে উন্মোচিত হয়েছে তা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবস্থা। ১৯৭৫ সালে আলোচ্য বইটি প্রকাশের সময় তিনি এ বিষয়ে লেখেন, “১৯২১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের কোন একটি দেশেও জনগণতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়নি। শুধু তাই নয়। এই সমগ্র অঞ্চলের কোন একটি দেশেও এখন বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা সম্পন্ন একটি কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। এই পরিস্থিতি যে নিদারুণ সঙ্কটজনক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।” (০০) কাজেই বিষয়বস্তুর আগাপাশতলা পরীক্ষা করে সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য তাঁকে নখশিখ খণ্ড রচনার প্রস্তাব করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “এই সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজন ১৯২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এবং তার পটভ‚মির বিস্তৃত পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যাগুলিকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং সেগুলির সমাধানের উপযুক্ত পথ নির্ধারণ করা।” আলোচ্য গ্রন্থে উমর নিজেই এই কাজে ব্রতী হয়েছেন। লিখেছেন, “এই কাজে যারা আত্মনিয়োগ করেছেন অথবা করতে চান তাঁদেরকে সহায়তার উদ্দেশ্যেই” বিষয়গুলি গ্রন্থভুক্ত ৫টি প্রবন্ধে উপস্থাপিত হয়েছে। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সাধারণভাবে কী কী সঙ্কট রয়েছে : ‘চরম দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি’ এবং ‘চরম বামপন্থী বিচ্যুতি’। সম্ভবত বাকি যেসব সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি এই দুই বৃহৎ সমস্যা সৃষ্টিতে সহায়ক ছিল। যেমন ‘বাস্তব বুদ্ধির ঘাটতি ও তত্ত্বগত দেউলিয়াপনা ও আপোষকামিতা’; ‘সংশোধনবাদী’ চিন্তা; ‘বিলোপবাদী’ চিন্তা; ‘কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কোন অংশই, সে হোক দক্ষিণ অথবা বামপন্থী, কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট’ না হওয়া; ‘কাণ্ডজ্ঞান’ না থাকা; ‘বিদ্যা এবং বুদ্ধি’ না থাকা; ‘আমলাতান্ত্রিক পার্টি নেতৃত্ব’; ‘ঘোরতর চক্রান্তমূলক আন্তঃপার্টি দ্বন্দ্ব’; ‘পার্টি লাইনের ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি ও জরুরী করণীয়’ সম্পর্কে আলোচনার জন্য ‘গণতান্ত্রিক কোন প্রক্রিয়া পার্টি সংগঠনের মধ্যে’ না থাকা ইত্যাদি। (উর:৪:৩০১-৩১২) উমর অনুভব করেছেন, “আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিপ্লবের স্তর, আমাদের আশু ও দূরবর্তী কর্তব্য সব কিছু বিষয়ে ধারণা সৃষ্টি করা দরকার” এবং “বাঙলাদেশে বিপ্লবের স্তর, বিপ্লবী শক্তিসমূহের বিন্যাস, বিপ্লবের শত্রæমিত্র” ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্লেষণ দরকার । তাই তিনি কমিউনিস্ট কে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কী; বিপ্লবী তত্ত¡ কী; বিপ্লবী পরিস্থিতি কী, বিপ্লবের স্তর কী; বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে কি বোঝায় ইতাদি সম্পর্কে দৃষ্টান্ত সহকারে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। পার্টির তত্ত্বীয় চিন্তা পরীক্ষা করার সময় তিনি লক্ষ করেছেন, ‘‘অধিকাংশই মুখস্ত বিদ্যা, তোতাপাখির বুলি অথবা নিতান্তই আত্মমুখী চিন্তা। সেগুলির সাথে মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের কোন সম্পর্ক নেই, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তবতারও নেই কোন সম্পর্ক।” কিন্তু “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া যেমন বিপ্লবী আন্দোলন হয় না, তেমনি কোন বিপ্লবী আন্দোলনে সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া সে বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব নয়।” এই পরিস্থিতিতে একজন কমিউনিস্ট এবং একটি কমিউনিস্ট পার্টির কী কর্তব্য? লিখেছেন, “আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার সব নিয়মকানুনের ব্যাপারে অজ্ঞতা, নিয়ম কানুনের জ্ঞান অর্জনে অনীহা এবং কোনভাবে সে সব বিষয় সম্পর্কে কিছু ঢালাও ধারণা থাকলেও সেগুলি উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে মেনে চলার ক্ষেত্রে বড় রকম ব্যর্থতাই এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসের একটা বিশেষ নেতিবাচক দিক, যা আবার পরিণত হয়েছে এক অনড় ঐতিহ্যে। সামগ্রিকভাবে দেশীয় পরিস্থিতি ও সেই সাথে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র অনুধাবন, সামাজিক শক্তিগুলির মধ্যে বাস্তব রাজনৈতিক কাজের ধারা নির্ধারণ ও ক্রমাগত সেই অনুযায়ী কাজ করে যাওয়া, কাজের যৌথ পর্যালোচনাকে একটা সঙ্গতিপূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ছাড়া বিপ্লবী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া ও বিপ্লব সাধন কোনক্রমেই সম্ভব নয়।” ১৯৯৭ সালে যখন গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ লেখেন তখনও তার মনে হয়েছে তাঁর প্রস্তাবিত বিষয়গুলি “এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট, এমনকি পুরোপুরি, প্রাসঙ্গিক।” (উর:৪:৩০০) আলোচ্য গ্রন্থের বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ। তা কয়েকটি প্রবন্ধে বা একটি গ্রন্থে সমাপ্য নয়। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই উমরের আরও অনেক প্রবন্ধে এবং গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট আলোচনা বিস্তৃতি লাভ করেছে। এসব গ্রন্থগুলি হচ্ছে বাঙলাদেশে মার্কসবাদ (১৯৮২), বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র (১৯৮২), একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভূমিকা (১৯৯৬) এবং বাঙলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি (১৯৯৭)। তরুণ কমিউনিস্ট, কমিউনিস্ট, রাজনীতিক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক সকলের পাঠ্যতালিকায় এই গ্রন্থটি আবশ্যক হিসেবে বিবেচিত বলেই আমরা মনে করি। – আফজালুল বাসার জুন, ২০২২