“ঠাকুরমার ঝুলি” বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার সাফল্যজনকভাবে তাঁর ঠাকুরমার ঝুলি বইয়ে সহজ সরল গ্রামীণ অনুষঙ্গময় ভাষায় চিরায়ত বাংলা রূপকথার সেরা কয়েকটি গল্পকে সংকলিত করেছিলেন বলেই হয়তাে পরবর্তী এক শাে বছর ধরে বাংলাসাহিত্যে রূপকথা এক আদরণীয় মাধ্যম হিসেবে পাঠকমহলে গৃহীত হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলা লােককথার বিভিন্ন আঙ্গিকের মধ্যে যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে সে-বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা এখনও সাহিত্যিক মহলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, যদিও বেশ কিছুকাল আগেই লােকতত্ত্ববিদ। ড. আশুতােষ ভট্টাচার্য বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এইসব আঙ্গিকের সুস্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন এবং মােটামুটিভাবে আঙ্গিকগুলাের সংজ্ঞা নিরূপণ করে দিয়েছেন। রূপকথা, লােককথা বা Folktales, উপকথা, ব্রতকথা ইত্যাদি শব্দগুলাে এখনও প্রায়শই একই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে যদিও এতে অর্থগত পার্থক্য অনেক। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অধিকারী জাতিগুলাের মধ্যে জাতীয় নিজস্বতা চিহ্নিত লৌকিক সাহিত্য গড়ে ওঠে; সে-সাহিত্যের প্রাণ হচ্ছে নানা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এক ধরনের কাহিনী। স্বভাবতই মানুষ ভালােবাসে গল্প শুনতে; গদ্য, পদ্য, গীতিকা ইত্যাদি নানা উপায়ে মানুষ গল্প বর্ণনা করে। গদ্য ভাষায় যে-গল্প বর্ণিত হয় তার নাম কথাসাহিত্য। বহু শতবর্ষ ধরে জনসাধারণের মুখে মুখে এ-সব কাহিনী গড়ে ওঠে বলে এ-সব কাহিনীকে লােককথা বলাই যথার্থ। ঠাকুরমার ঝুলি বইয়ের সবগুলাে গল্পই লােককথা, রূপকথা নয়। বইয়ের প্রথম দুটি পর্ব হল দুধের সাগর ও রূপ-রাসী। এগুলাের দশটি গল্পই রূপকথা; চ্যাং ব্যাং পর্বের গল্পগুলাে লােককথা হলেও রূপকথা নয়। সুতরাং ঠাকুরমার ঝুলি সম্পন্ন অর্থে রূপকথার সংকলন নয়। তাহলে কাকে বলে রূপকথা? বাংলাসাহিত্যে এ নিয়ে এখনও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নিরূপিত না হলেও দীনেশচন্দ্র সেন, ড. আশুতােষ ভট্টাচার্য ও ড. মলয় বসু বাংলা রূপকথার বৈশিষ্ট্যগুলাে লক্ষ করে রূপকথাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। আশুতােষ ভট্টাচার্য এবং মলয় বসু উভয়েই এ-কাজে জার্মান তাত্ত্বিক Albert Wesselski-র Versuch einer theorie des Marchens-এর বরাত দিয়েছেন। বর্তমান রচনাতেও ওই দৃষ্টিভঙ্গিকেই গ্রহণযােগ্য বলে মনে করা হয়েছে। বাংলাভাষার রূপকথা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে সাধারণভাবে Fairy Tales শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু একটু মনােযােগের সঙ্গে লক্ষ করলেই বােঝা যাবে যে Fairy Tales আর রূপকথা এক নয়। কারণ বাংলা লােককথার দু-একটি গল্পে পরীর উপস্থিতি থাকলেও আমরা যাকে রূপকথা বলি তার সবই পরীকাহিনী নয়। গ্রিম ভাইয়েরা তাদের লােককথার সংকলনে যে-সব গল্প অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাতে পরীর উপস্থিতি ছিল বলে সেগুলােকে Fairy Tales বলা যায়। কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলােতে পরীর উপস্থিতি নেই। বাংলা লােককথার কিছু কিছু গল্পে বাঘ, কুমির, শেয়াল, কুকুর, বিড়াল, কাক, চিল, চড়াই ইত্যাদি পশুপাখির অস্তিত্ব আছে। এসব গল্পের সত্যি পরিচয় রূপকথা নয়— উপকথা। কিছু লােককথা আছে যেগুলাের উপজীব্য দেবদেবীর মাহাত্ম প্রচার। এধরনের গল্পকে বলা হয় ব্রতকথা। দেব-দেবীর মাহাত্মকীর্তনের জন্য সে-সব গল্পের চরিত্ররা নানা ব্রত পালন করে। গঠনগত দিক থেকে অনেকটা মিল আছে বলেও এগুলােকে রূপকথা বলে ভ্রম হতে পারে। কিছু কিছু গল্প গড়ে উঠেছে ভূতপ্রেত নিয়ে। এগুলােও রূপকথা নয়। কোনও কোনও লােককথায় অনেক সময় দেখা গেছে ইতিহাসের চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, কিংবদন্তির গল্প প্রাধান্য পেয়েছে। এগুলােও রূপকথা নয়। অর্থাৎ বাংলা রূপকথার গল্পকে হতে হবে এমন যাতে পরীদের ভূমিকা প্রধান হবে না, গল্পগুলাে কোনও দেবদেবীর মাহাত্ম প্রচারের বাহন হবে না, ইতিহাসের কোনও চরিত্র নায়ক হয়ে উঠবে না, গল্পে ভূতপ্রেত বা পশুপক্ষীর উপস্থিতি থাকলেও তারা গল্পের নিয়ন্তা হবে না। রূপকথার গল্পে যে-সব পশুপাখি থাকবে তারা হবে অপ্রাকৃত যেমন রাক্ষস-রাক্ষসী, পক্ষীরাজ, বেঙ্গমা-বেঙ্গমী ও শুক-শারী ইত্যাদি। সবকিছুর ওপরে সে-সব গল্পে মানুষের প্রাধান্য থাকতে হবে। তবে সে-মানুষের বাস্তব পরিচয় থাকবে না। গল্পগুলােতে যে-সব দেশের উল্লেখ থাকবে সে-সম্বন্ধে পাঠকের কৌতূহল জাগবে না। নর-নারীর ভালােবাসা এবং নিয়তি বা অদৃষ্ট হবে সে-সব গল্পের প্রধান উপজীব্য। এসব গল্পকে অবশ্যই মিলনাত্মক হতে হবে এবং এতে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবে। এসব গল্পে দুষ্টের পরাজয় ঘটবে। প্রাচীন লােকবিশ্বাস বা ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে থাকবে গল্পগুলাের সঙ্গে। কিন্তু সরাসরি কোনও নীতি বা উপদেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে না। রূপকথার গল্পে কোনও কৌতুকরস থাকবে না। ভাষা হবে কাব্যধর্মী, সরল, গ্রামীণ, স্নিগ্ধ ও অনুভূতিময় গদ্যে গল্পের ঘটনাবলি বর্ণিত হবে।