“কালের ইতিহাসে মহাভারত” বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ
মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণ দুর্যোধনকে ত্যাগ করার পরামর্শ দিতে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, আপনার দুর্বলতার জন্য যেন ক্ষত্রিয়গণ বিনষ্ট হয়। কুলরক্ষার প্রয়ােজনে একজনকে ত্যাগ করবে, গ্রামরক্ষার জন্য কুলত্যাগ, দেশরক্ষার জন্য গ্রামত্যাগ এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করতে হবে। দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে পারেননি ধৃতরাষ্ট্র। এজন্য তাঁকে শােচনীয় পরিণাম ভােগ করতে হয়েছে।
কৃষ্ণ তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে পৃথিবীর(মহাভারতের পৃথিবী) অধীশ্বর রূপে অভিষিক্ত করেছেন কিন্তু নিজের কুল ও দেশ রক্ষা করতে পারেননি। নিজের জীবদ্দশায় যদুবংশের মহা সর্বনাশ ঘটেছে। আর নিজে বরণ করেছেন গ্লানিকর মৃত্যু।
যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করেছেন। কিন্তু মাতা কুন্তীকে নিজের রাজ্যে ধরে রাখতে পারেননি। যুদ্ধে জয়লাভ পরাজয়তুল্য শােকের কারণরূপে দেখা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভ্রাতা চতুষ্টয় ও দ্রৌপদীকে নিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে হয়েছে তাঁকে। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন- সমাজ বদলের স্বপ্ন, যুদ্ধবাজদের সমাজ ভেঙে নয়া সমাজ গঠনের স্বপ্ন তা বাস্তবায়নের সরাসরি কার্যকর কোন উদ্যোগ নিতেও দেখা গেলনা তাঁকে। অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভাবুকই থেকে গেলেন শেষপর্যন্ত।
তা হলে কি ব্যর্থতার গ্লানি ও তা থেকে গভীর নৈরাশ্য ও হতাশা কবলিত হয়ে পৃথিবী ত্যাগ – এটাই মহাভারতের শেষ কথা! মাঝে মাঝে এরকমই মনে হয়।
মহাভারতের সমগ্র পৃথিবীর রাজাদের উচ্ছেদ করে পৃথিবীর ভার যুধিষ্ঠিরের হাতে অর্পণ করে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণ? ক্ষত্রিয় রাজধর্মের চরম নিষ্ঠুরতার প্রতি যুধিষ্ঠিরের বিরূপতা দৃষ্টে তিনি কি ভেবেছিলেন যে যুধিষ্ঠির প্রজাবৎসল রাজা হবেন এবং তাঁর রাজ্যে প্রজারা নৃশংস যুদ্ধবাজ রাজাদের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে শান্তিতে বসবাস করবে? হয়তাে ভেবেছিলেন (কুরুক্ষেত্রের মহাসমরকেও ধর্ম রক্ষার তথা ধর্মযুদ্ধ বলা হয়েছে) কিন্তু কৃষ্ণের এ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট বক্তব্য মহাভারতে নেই। তিনি একে একে রাজাদের হত্যা করে এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সব রাজাদের বিনাশ ঘটিয়ে যুদ্ধ পরম্পরার..যে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও তা থেমে থাকেনি।
ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত সাফল্য অন্যদিক থেকে বিস্ময়কর। তিনি জীবদ্দশায়ই ভগবানের বিভূতি অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর এমনকি আজও বিপুল ভক্তকুলের কাছে সেভাবেই পূজিত হয়ে আসছেন। আর তাঁর যে মৃত্যুকে আমরা গ্লানিকর বলছি, তার ক্ষেত্রে তা | সেরকম নাও হতে পারে। হয়তাে নির্লিপ্তভাবেই এই ভবিতব্যকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কেননা ভােগের ক্ষমতার মতােই তাঁর ছিলাে অসাধারণ ত্যাগের ক্ষমতাও। তিনি যদুবংশীয়দের রাজ্য হাতে পেয়েছেন, দুর্বিপাকে তা রক্ষাও করেছেন কিন্তু সত্তাইকে রাজা করেছেন। নিজে রাজা হননি। ক্ষত্রিয় রাজতন্ত্রে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি যুধিষ্ঠিরকে পৃথিবীর অধীশ্বর করেছেন কিন্তু তার কোন অংশ দাবি করেননি। সর্বাবস্থায় তিনি নির্লিপ্ত ও নিরাসক্ত থাকতে পারতেন। ভগবদ্গীতায়ও তিনি সেরকম পরামর্শই দিয়েছেন। তিনি যে ভগবানরূপে মহিমান্বিত হন এও তার একটা বড় কারণ বটে।
অন্যদিকে যুধিষ্ঠির, তিনি পৃথিবী ত্যাগ করলেন বটে কিন্তু জানিয়ে দিয়ে গেলেন- মহাভারতে যে বলা হয়েছে এ জগতে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই গুহ্যং ব্রহ্ম তদিদং বাে ব্রবীমি / ন মানুষাচ্ছেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ এই পৃথিবীতে সেই বােধের অস্তিত্ব নেই। যুদ্ধবাজদের এই পৃথিবী মানুষের বাসযােগ্য নয়। এই পথিবীকে বদলাতে হবে আর বদলাতে গেলে যে যুগে রাজা ছিল না, রাজ্য ও রাজদণ্ড ছিল না, দণ্ডাৰ্হ লােকও ছিল না, প্রজারা ধর্মানুসারে (বিবেকসম্মত পন্থায়) পরস্পরকে রক্ষা করতাে, সত্যযুগেরও আগের সেই যুগকে সেই যুগের দর্শনকেই ভিত্তি করে এগুতে হবে। সহজেই অনুমান করা যায় সে যুগ আদিম সাম্যবাদী সমাজের যুগ। ভীষ্ম কথিত অতীত ইতিহাসের সেই যুগের বার্তাকে ভুলতে পারেননি যুধিষ্ঠির। যুগবাস্তবতার নিরিখে ভিন্ন মাত্রায় তাকেই বাস্ত বায়িত করতে হবে। এটাই মহাভারতের শেষ কথা।
যুধিষ্ঠির বুঝতে পেরেছিলেন সে সাধ্য তার নেই। তাই তিনি নিপ্রয়ােজন এই পৃথিবীতে, সুতরাং মহাপ্রস্থান। একদিক থেকে এ পলায়নের নামান্তর বটে কিন্তু অন্যদিকে এ হচ্ছে বিশেষ পন্থায় বিচ্ছিন্ন ও সেই সূত্রে দুর্বল ব্যক্তি মানুষের প্রায় একক প্রতিবাদ। মহাভারতের পৃথিবীতে অরাজক পরিস্থিতির জন্য দায়ী যুদ্ধবাজ অমানবিক ক্ষত্রিয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিবাদ নিজের বিরুদ্ধেও। কেননা তিনিও এর বাইরে থাকতে পারেননি। এরূপ প্রতিবাদও সময়ের বিচারে কম কথা নয়।
আধিপত্যবাদী যুদ্ধবাজদের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে, বদলাতে হবে পৃথিবীকে মহাভারতে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
মহাভারতযুগের সেই আধিপত্যবাদ, সেই শশাষণ, সেই বঞ্চনা বিচিত্ররূপে আজও পৃথিবীতে প্রকটভাবে বিদ্যমান। মহাভারতােক্ত মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই’ -সেই মানুষের বাসযােগ্য পৃথিবী আজও অনুপস্থিত। সেই পৃথিবী নির্মাণের জন্য ভিন্নমাত্রায় বিচ্ছিন্ন নয়, সংগঠিত প্রতিবাদ ও সংগ্রাম আজও চলমান পৃথিবীতে। তাই মহাভারতের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক।