‘হিন্দু পুরাণ’ বইয়ের ভূমিকাঃ
আমরা বাঙালিরা মুসলিম আর সনাতন এ দু টি প্রধান ধর্ম বিশ্বাসে বিভক্ত আছি। শান্তি, সহিষ্ণুতা ও মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের সমাজের ভিত্তিকে দৃঢ়তর করছে। একের ধর্ম বিশ্বাস অপরে জ্ঞাত হবেন এটিই স্বাভাবিক। পবিত্র কুরআনের উদ্বোধনি অধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ শুনে অনেক অ-মুসলিম আমার সম্মুখে অবাক বিস্ময়ে এর নিবেদনের চমৎকারিত্ব অনুভব করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের কয়েকটি বাক্য শুনে নিশ্চিত ধারণা করেছেন যে, এটি পরম প্রভু হতে অবতারিত। এর বাণি অমৃতময়; এ বাণি মর্মের গভীরে অনুভূত হয়! অন্যদিকে সনাতন ধর্ম মতের প্রধানতম গ্রন্থ বেদ। এর অর্থ জ্ঞান। এটি পাঠ করলে অনুধাবন করা যায় ধর্মীয় মোড়কে কত গভীর জ্ঞান এতে লুক্কায়িত আছে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আরব অধিকারে আসার পর আরব পণ্ডিতেরা তাঁদের গ্রন্থরাজি পাঠ করে নিজেরা মহাপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। জ্ঞানের প্রবাহ নিরর্গলিত থাকা প্রয়োজন। জ্ঞান তাঁর অন্তর্নিহিত শক্তি বলে টিকে থাকবে। জ্ঞানের সঙ্গে অসারতা মিশ্র থাকলে তা অপনোদিত হবে। পুরাণকাহিনির বিশ্বাস প্রসঙ্গে কিছু না বলে এর সাহিত্যিক মূল্য সম্পর্কে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। প্রাচীনের মর্যাদা অনন্য। পুরাকালে কবে কোন সম্রাট স্তম্ভ গাত্রে খোদাই করে লিখে গেছেন অমোঘ বাণি, ‘সত্য মেব জয়তে’- ‘ট্রুথ অ্যালোন ট্রিয়াম্ফ্’। কালের প্রবাহে ভেসে গেছে তার রাজ্য-রাজধানি; অথচ অমলিন থেকে গেছে সে অমোঘ বাণি। অতীত গর্ভে সম্রাট শাহ্জাহান রয়েছেন অতল তল; তাঁর গাঁথা প্রেমহার আগ্রায় আজও শুভ্র সমুজ্জ্বল। কোথা আজ কালিদাস? তাঁর কণ্ঠে আজও আছে যক্ষের বিরহি হৃদয়ের দির্ঘশ্বাস। পুরাণকাহিনি পৌরুষেয় কি অপৌরুষেয় সে প্রশ্ন থাক, লেখনীতে সে কাহিনি চলৎশক্তি পাক। এ কাহিনির বর্ণনা অপূর্ব-অদ্ভুত। ঘটনার ঘনঘটা এতো অধিক শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে যে, মনে হবে এটি কল্পনার চেয়েও অধিক কল্পনাময়। এটি রূপময়, রসময়। কখনও বীর রসে সিক্ত, কখনও শৃঙ্গার রসে। ওল্ডটেস্টামেন্টের জেনেসিস পর্বে সৃষ্টির মহারহস্য উদ্ঘাটিত আছে। এ পুরাণকাহিনিতেও সৃষ্টির বিভিন্ন পর্ব বিবৃত আছে। এ সৃষ্টির মাঝে সুন্দরতম সৃষ্টি হচ্ছে অপ্সরাগণ। অপ্ (জল) হতে এদের সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের সংখ্যা ৬০ কোটি। প্রধান অপ্সর রমণি হচ্ছেন : ১. উর্বশি, ২. তিলোত্তমা, ৩. রম্ভা ও ৪. মানেকা। প্রত্যেকে চরমতম সুন্দরি। প্রত্যেকে চির যৌবনা-মৌবনা; সুকান্তা, সুবর্ণা, সুদন্তা, সুকুন্তলা, সুলোচনা, সুহাসিনি ও সুমধুর ভাষিনি! তাঁদের কণ্ঠ মুরলি ধ্বনি সদৃশ্য মুররি মনোহর। তাঁদের গাত্র বর্ণ যথাক্রমে সাদা কুন্দ ফুলের মতো, লাল মন্দার ফুলের মতো, হলুদ অনুপম রম্ভার মতো ও গৈরিক। দেবগণ তাঁদের রূপে মোহিত থাকেন। তাঁদের বিবসন উপস্থিতি যোজন যোজন কাল যাবত ধ্যানমগ্ন ঋষিদের ধ্যান ভঙ্গ করে। এমনতর চমৎকার ঘটনারাজিতে এ লেখা ভরপুর।