ভূমিকা
এক সময় একটা ধারণার আামি খুব জোর দিতাম। তা হলো, মানুষ মরে কিন্তু তার বিশ্বাস বা ভাবাদর্শ মরে না। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, মানুষের সঙ্গে তার বিশ্বাসও মরে, ভাবাদর্শ না মরলেও বদলে যায়। তবে, বৃহত্তর কোনো জনগোষ্ঠির বিশেষ কোনো আকাঙ্ক্ষা যখন বিশ্বাসে পরিণত হয় দেরিতে হলেও তখন তা আলোর মুখ দেখে, যত রক্তপাত আর জীবন বিনষ্টই তাতে হোক। কিন্তুওই বিশ্বাসের অর্জন টিকে থাকবে না-কি ধূলোয় মিশে যাবে তা নির্ভর করে পরবর্তী প্রজন্মের যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের ওপর। অলস, অকর্মণ্য, অদূরদর্শী কিংবা ভিন্ন ভাবাদর্শের অনুসারী লোকদের ওপর এমন মহান দায়িত্ব বর্তালে ফল খারাপই হয়। এই খারাপের দায়ভার তখন সংশ্লিষ্ট মানুষেদের বহন করা ছাড়া উপায় থাকে না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষেরাও এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। দূরে দর্শকদের সারিতে দাঁড়িয়ে আমরা তা শুধু প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি কিছু করার বা বলার সামথ্য এখন আর আমাদের নেই। এই উপন্যাসের দু’টি প্রধান চরিত্র দু’জন যুবক। নিমাই আর হেলাল। তারা দুটি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। চিন্তা-ভাবনার দিক থেকেও তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। নিমাই বামপন্থী ভাবাদর্শের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত , ছাত্রজীবন অসমাপ্ত থাকায় প্রাইভেট টিউশনিকে বেছে নিয়েছে জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে। এরপরও তার আদর্শ ও বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটেনি।অপরজন হেলাল খুবই সাধারণ ছেলে।উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে অন্যের দয়ায়। তার মাঝেও শুভ-অশুভ চিন্তার অসংখ্য বুদ্বুদ ফেনায়িত হয়। আর্থিক দৈন্য তাদের একছাদের নিচে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ‘দু’জনেই আংশিক হলেও বাস্তুচ্যুত (Rootless) , এই বিশ্বাস তাদের দু’জনকে মনের দিক থেকে করে দিয়েছে আরও কাছাকাছি। ফলে তারা যত না ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে একে অপরের সুখ দুঃখের ভাগীদার।মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অলিখিত অজ্ঞাত কমিটমেন্ট থেকে তারা একচুলও সরে যায় নি। যখন তাদের অশেষ দুঃখপূর্ণ সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আসে সেই চরম আঘাত, যা তাদের সব স্বপ্ন ও সুন্দরের আয়োজনকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
আপাতদৃষ্টিতে এ উপন্যাসের পরিণতি দেখে মনে হতে পারে যে, এমন রক্তপাত ও মৃত্যু অর্থহীন। কিন্তু আমার বিশ্বাস বলছে, অর্থহীন নয়। ওই বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে নতুন মানুষ, নতুন চিন্তা এবং নতুন বিশ্বাসের। তারা অবশ্যই সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লড়বে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। তারা পূর্ববর্তী বিশ্বাসকে নিজেদের অগ্রসর বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চয়ই এমন এক বিশ্বাসের জন্ম দেবে যা তাদের গন্তব্য পৌঁছে দিতে পারবে। তারা নিজস্ব বিশ্বাস ও প্রচলিত নিয়মের নিগড়ে বন্দি থেকেও মুক্তির জন্য লড়াই করেছে, মুক্তির স্বাদ পেতে চেয়েছে।ইন্টারনেট যুগের একটি অস্থির সময়কে ধারণ করেছে এ উপন্যাস। সময়ই বলবে এর সফলতা কতটুকু…।