ভূমিকা সকালবেলা বেড়াতে বেরিয়ে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতাে। তিনি আসতেন পুবদিক থেকে, আর আমি যেতুম পশ্চিমদিক থেকে। আলাপ ছিল না, তবে নমস্কারবিনিময় ছিল। একদিন তিনি আমাকে পথের মাঝখানে আটক করে ইংরেজীতে বলেন,শুনছি আপনি নাকি একজন প্রসিদ্ধ লেখক। আমি কী বলব, মুচকে হাসি। তখন তিনি আমার কাছে সরে এসে বলেন, “এই যা মালমশলা পেলেন এ দিয়ে আপনি তিন ভলুম লিখতে পারবেন।” দিন দুই আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমাদের সকলের মন ভরে রয়েছে। আমি বলি, “তা লেখা যায়।” তিনি এগিয়ে যেতে যেতে আবার পেছন ফেরেন। তর্জনী উঁচিয়ে জোর দিয়ে বলেন, “তিন ভলুম।” সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোেক বােধহয় পাঞ্জাবী কি সিন্ধী। আজকাল আর তাকে দেখতে পাইনে। তাঁর সেই উক্তি কিন্তু ভুলে যাইনি। বাংলাদেশে যা ঘটে গেল তা নিয়ে অনায়াসেই তিন ভলুমের একখানা উপন্যাস লেখা যায়। লেখবার মতাে বিষয় বটে। আমি নই, ওপারের কোনও যােগ্যতর পাত্র লিখবেন। যিনি প্রত্যক্ষদর্শী। তা বলে আমি তাে একেবারে নীরব থাকতে পারিনে। আমিও একজন সাক্ষী। দূরের সাক্ষী। আমার বক্তব্য আমি প্রবন্ধ আকারে মাসের পর মাস পেশ করেছি। কারও নজরে পড়েছে, কারও নজরে পড়েনি। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তা আমরা কেউ পূর্বে থেকে অনুমান করতে পারিনি। তই যখন যেমন মনে হয়েছে তখন তেমন লিখেছি। দিনে দিনে আমার মত বদলেছে। গােড়ায় যেটা সমর্থন করিনি পরে সেটা সমর্থন করেছি। কিন্তু বরাবরই আমি রক্তপাত এড়াতে, এড়াতে না পারলে সীমার মধ্যে রাখতে চেষ্টা করেছি। দুর্ভাগ্য যে প্রাণহানি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মর্যাদাহানি তাে অভূতপূর্ব। সংগ্রামটা যতদিন চলছিল ততদিন আমার অন্তরে বিষাদ ছাড়া আর কিছু ছিল না। সংগ্রামের পরেও অনেকদিন অবধি। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পর থেকেই আমার বিষাদের ভাবটা কেটে আসছে। ত্রিশ লক্ষের মৃত্যুযন্ত্রণা ভােলা যায় না। আর ওই অগণিত নারীর জীবনযন্ত্রণা সদ্যোজাত সন্তানের মুখ চেয়ে মা যেমন তার প্রসবযন্ত্রণা ভােলে তেমনি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মুখ চেয়ে ভুলতে হবে এসব যন্ত্রণা। “শেখ শুভােদয়া” নামে একখানি প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেই পুঁথির নাম অনুসারে আমার এই গ্রন্থের নামকরণ। এবারেও একজন শেখ বাংলাদেশের পূর্ব গগনে উদয় হয়েছেন। তাঁর উদয়ও শুভােদয়। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ বলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উদয় হয়েছে। তার উদয়ও শুভােদুয়া প্রবন্ধের সংগ্রহে কবিতার সংযােজন আদালত প্রথা নয়। বিশেষ কারণেই এটা করা হলাে। এই গ্রন্থটি একহিসাবে একটি স্মারক গ্রন্থ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। আরও কয়েকটি ছড়াও এই উপলক্ষে লিখেছি। সেগুলি আমার নতুন ছড়ার বইয়ের সামিল হচ্ছে। এগুলিও তার সামিল হবে।