চব্বিশ বছরের শাসন, শোষণ, বৈষম্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাথে সাথে পাকিস্তানি শাসকেরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতির উপর। এ জাতির ন্যায়সঙ্গত উচ্চকিত কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য নির্বিচারে হত্যা করেছিল ত্রিশলক্ষ নিরপরাধ বাঙালিকে। চারলক্ষ নারীর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল পাশবিক উল্লাসে। বস্তুত এত কমসময়ে এতবেশি সংখ্যক লোককে হত্যা করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নিতান্তই বিরল। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সারা দেশের মত উত্তরের জনপদও পরিণত হয়েছিল ভয়াল এক বধ্যভূমিতে। হত্যা ও নিপীড়নের ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়েছিল নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার চরম মাত্রা। পাষণ্ডরা এক্ষেত্রে হিটলারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে সময় ঘাতকরা ছয়দফাকে উদ্ধৃত করে নিরস্ত্র বাঙালিদের শরীর ছয়খণ্ডে খণ্ডিত করত। উত্তপ্ত বয়লারে নিক্ষেপ করত জ্যান্ত মানুষ। হাত পা বেঁধে খাঁচায় নিক্ষেপ করে হিংস্রবাঘ দিয়ে হত্যা করাত বাঙালিদের। বয়স নির্বিশেষে নারীদের উপর চালাত আদিম কায়দায় অত্যাচার। এভাবে এক অমানবিক তরিকায় তারা বাঙালির জাতিসত্তা বিনাশের উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছিল। নৃতাত্ত্বিকভাবে এ জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে এই বাঙাল মুলুককে বাঙালি শূন্য করে দেয়ার এক মরণ খেলায় মেতেছিল। তদুপরি তারা বাঙালি জাতির জাগরণ অবদমিত করতে পরেনি। শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতি পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ জন্য উৎসর্গ করতে হয় ত্রিশলক্ষ জীবন। চারলক্ষ মা বোনকে খোয়াতে হয় সম্ভ্রম। দেশছাড়া হতে হয় এক কোটি বাঙালিকে। স্বাধীন দেশের পতাকাটি ওড়াতে হয় বাংলার রক্তস্নাত ধ্বংসস্তুপে। এ সবই আমাদের স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সারবত্তা উপলব্ধির জন্য, স্বাধীনতার চেতনা শানিত করার জন্য, তাই গণহত্যার দিকে দৃকপাতকরণ অত্যাবশ্যক, সে নিরিখেই সীমিত পরিসরের এই গ্রন্থে উত্তরাঞ্চলের গণহত্যার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। আশা করি দেশ প্রেমিক পাঠকদের কাছে গ্রন্থটি গ্রহণীয় হবে।