“কপালকুন্ডলা” বইটি সম্পর্কে কিছু কথা:
কপালকুণ্ডলা’ বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বিতীয় উপন্যাস। দুগেশনন্দিনী’র প্রায় দুই বৎসর পরেই কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই গ্রন্থটি তার মেজদা সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন।
কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের পটভূমি মেদিনীপুর। অনেকেই অনুমান করেন, বঙ্কিমচন্দ্র যখন মেদিনীপুরের নেগুঁয়াতে কাজ করতেন তখনই এই গ্রন্থ-পরিকল্পনার কারণ ঘটে। সে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের কথা। পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র যখন নেগুঁয়াতে ছিলেন তখন মাঝে মাঝে এক কাপালিক সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। সেই সন্ন্যাসী সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা হয়েছিল যে, তিনি সমুদ্র তীরবর্তী কোন বনে বাস করেন। মেদিনীপুরে বাসকালে সন্ন্যাসী ও প্রেতের বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত হয়েছিল।
এ সম্বন্ধে প্রচলিত গালগল্পের সারবত্তা বিষয়ে স্বভাবতঃই সন্দেহ জাগে। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনে যে সন্ন্যাসীর প্রভাব প্রচুর ছিল, তাঁর উপন্যাসগুলাে তার সাক্ষ্য। কোন সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এসে তাঁদের সাধন-পদ্ধতি সম্বন্ধে জানবার কৌতূহল অস্বাভাবিক নয়। বিশেষভাবে গৃহস্থ বঙ্কিম সন্ন্যাস-জীবনকে গার্হস্থ্য পটভূমিতে স্থাপন করে পরীক্ষা করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। পূর্ণচন্দ্রের বর্ণনায় জানা যায়, তার মনের এই প্রশ্ন তিনি দীনবন্ধু এবং সঞ্জীবচন্দ্রকে করেছিলেন। প্রশ্নটি এই-“যদি শিশুকাল হইতে ষােল বৎসর পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোেক সমুদ্রতীরে বনমধ্যে কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিত হয়, কখনও কাপালিক ভিন্ন অন্য কাহারও মুখ না দেখিতে পায় এবং সমাজের কিছুই জানিতে না পায়, কেবল বনে বনে সমুদ্রতীরে বেড়ায়, পরে সেই স্ত্রীলােকটিকে কেহ বিবাহ করিয়া সমাজে লইয়া আইসে, তবে সমাজ সংসর্গে কাহার কতদূর পরিবর্তন হইতে পারে, এবং তাহার উপরে কাপালিকের প্রভাব কি একেবারে অন্তর্হিত হইবে?”
দীনবন্ধু কোন উত্তর দেননি। সঞ্জীবচন্দ্র প্রথমে রসিকতা করে বলেছিলেন, মেয়েটি গরিবের ঘরে পড়লে চোর হবে। পরে বলেছিলেন- কিছুদিন সন্ন্যাসীর প্রভাব থাকবে বটে, তবে ক্রমে স্বামী-পুত্রের প্রতি প্রেম ও স্নেহে সংসারী হয়ে পড়বে।
তারপর বােধ হয় দীর্ঘকাল ধরে মনের মধ্যে তিনি এই প্রশ্নের উপযুক্ত সমাধান খুঁজেছিলেন। বারুইপুরে থাকাকালে তাঁর এই গ্রন্থ রচনার সুযোেগ ঘটে। গ্রন্থের প্রথমে দুরন্ত কুটিকার বর্ণনায় তিনি বাল্যকালের এক ভয়ানক কুয়াশার স্মৃতিচারণ করেছিলেন, এ সংবাদ দিয়েছেন পূর্ণচন্দ্র। তিনি আরও অনুমান করেন, কোনও কুলত্যাগিনী গৃহস্থ বধূর কাহিনী অবলম্বনে মতিবিবি’ চরিত্রটি রচিত।
বিক্ষিপ্ত বাস্তব ঘটনাবলীর সাহায্যে বঙ্কিম মানসে অখণ্ড সৌন্দার্যানুভূতিতে কপালকুণ্ডলা’র জন্ম হয়।