বইয়ের ফ্ল্যাপ
সৌন্দর্য আশ্রিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী চেতনার মানবিক স্বাধীনতার নাম রোমান্টিসিজম। যেখানে ক্রিয়াশীল থাকে উদ্বেগ ও ভয় : সেইসাথে অসম্ভবের গোয়ার্তুমি : একাধারে মনোরোগ ও প্রশান্তি। এই মনোরোগ আর প্রশান্তির নাম ‘মাথার এপ্রোন’— যে এপ্রোন নিজেই নিজের সাথে কথা বলছে স্বন্মোচিত আবেগ আর স্বগতকথনের আড়াল থেকে। প্রকৃত প্রস্তাবে এইগুলান হইল সানাউল্লাহ সাগরের ভাষিক ‘প্ররোচনা’ : এমনকি ইহা হয় ‘প্যারাডক্স’ : এইগুলান বাদ দিয়া একজন জন্মজাত কবি স্ফূর্তি লাভ করতে পারে না : পারে না রাজকীয় নকশার আড়ালে আউশের বাক্য গুছিয়ে নিয়ে হাতে হাতে কৈশোর বিলানো ব্যথা উচ্চারণ করতে।
‘ওই যে এপ্রোনগার্ল
তার চশমা
ওখানে ঢেউ জমা রেখেছি’
— এই জমা রাখা ঢেউয়ের মর্মপাঠই তার কবিতা : যাকে ঠিক ভাষার ভিতর আটকিয়ে রাখা যায় না : যা এতটাই সূক্ষ্ণ প্ররোচনা যে যাকে চিন্তা ও শব্দ দিয়ে ধরতে গেলে ফাঁক ফোকর গলে পালিয়ে যায়। ভাষা-অতিরিক্ত এই পালিয়ে যাওয়া অনুভবের প্রিফেক্স ‘মাথার এপ্রোন’।
– শিমুল মাহমুদ
……………. শুরুর কথা…
সারিবদ্ধ পালে কিংবা সরু রেখা ধরে চলাটা আমার—না যাপন না কবিতা; কোনোটাতেই নেই। আমার পছন্দ থ্রিল। তাল-মাতাল হাওয়া। আবার কখনো সোজা হয়ে কাকতাড়ুয়ার মতোন দাঁড়িয়ে থাকা। ‘মাথার এপ্রোন’ বর্ণগোত্রের কিছু প্রতিনিধির দৌড় খেলেছি মৌলিক ছন্দের নিরীক্ষায়। বমির তৃষ্ণা থেকে মূলত লেখা এইসব পঙ্ক্তি। যার সারা শরীরে লেগে আছি আমি, আমার স্পর্শ—অথবা গড় মানুষের ঘুম ও ঘুমের যন্ত্রণা। ঘুমলেও রাত চলে যায়—আর না ঘুমালেও চলে যায়। রাতের শরীর নিয়ে খেলা না খেলাটা কোনো বিষয় না। তবে যে খেলতে জানে সে তার নিজস্ব রীতিতেই খেলতে থাকে। সেখানে রাত কিংবা তার শরীর মুখ্য নয়। মূখ্য নয় খেলোয়াড় বা তার চরিত্রও। খেলা চলে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। আর যারা দর্শক হতে চায় তাদের জন্য কোনো খেলার আগ্রহই হয়তো থাকে না। কিন্তু তারাও খেলাটাকে তাদের ঝুলিতে নিয়ে ঘরে ফেরে—যে যার ঘরে। এক্কেবারে একান্ত কোটরে।
ঘুমের মধ্যে রাত আসে; আমি যখন কলম নিতে যাই—ফর্সা খুঁজতে থাকি, তখন কেউ একজন পালিয়ে যায়। তাকে খুঁজতে গিয়ে আমার ঘুম ও রাত দুটোই হারিয়ে যায়। ভুলে যেতে থাকি আমার হারানোর অভ্যাসকে। যে অভ্যাস আমাকে থামিয়ে রাখে কিংবা হাঁটার মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু কোনো কিছুর কাছেই আমি গুরুত্বপূর্ণ অংক হয়ে দাঁড়াতে পারি না। বরং বীজগণিত, পাটীগণিত, ত্রিকোণমিতিতে খুঁজি। নামতে নামতে শিখে ফেলি মিথ্যা অহংকার। তারপর নদী—তারপর সমুদ্র—তারপর আবার একগুচ্ছ রাত…
আমি নিঃসঙ্গতা নিয়ে খেলতে পছন্দ করি। কালো সংখ্যা আমাকে গোলাপিতে দাঁড়াতে দেয় না। আমি পড়ি—পড়তে এবং পুড়তে বুঝে যাই স্বপ্ন বিচারের অপেক্ষা করে না। আর তখনই আমার ছায়া বড় হতে থাকে। বাড়তে বাড়তে একটি দুনিয়ায় পরিণত হয়। সেই দুনিয়া থেকে তৈরি হয় অনেক দুনিয়া। যেখানে পুরাটাই আমি! অথবা কোনো কিছুতেই আমি নেই। ঠিক তেমনই ‘মাথার এপ্রোন’। শব্দ ভেঙে, জোড়া তালি দিয়ে, কখনো উল্টোপাল্টাভাবেও দেখতে চেষ্টা করেছি। আবার মৌলিক ছন্দের যাবতীয় সংজ্ঞাকেও পাশ কাটিয়ে খেলতে খেলতে নিজেকে নিয়ে গেছি মানুষ ও মানুষের আড়ালে রাখা ভাষার কাছাকাছি।
আমার দীর্ঘায়িত স্বপ্নেরা দূর থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে ডেকেছে আর আমি ছুটেছি লাগাম ছাড়া। কী এক ঘোরে; তৃষ্ণার্ত ঈর্ষায় জ¦লে গেছি রাতের পর রাত। ঘুমের ঘোরে সাবলীল সুর তৈরি হয়, স্বপ্নঘরে তার স্বাধীন বিচরণ। মায়াময় নর্তকীদের নিবিড় আলিঙ্গন! সকালের কোমল আলো আর মধ্যবিত্ত ব্যস্ততার যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হয় জীবনের চিত্রনাট্য। মাতাল শহর—মুগ্ধ ছায়া—বৈধ হাট এইসব আমার চিরপরিচিত মানুষের চিরপরিচিত স্বর। হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখি—পড়তে পড়তে মানুষ দেখি—অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আন্তরিক পাঠ নিই মানুষের। সতেজ ভাবনায় অধ্যয়ন করি প্রতিটি প্রত্যন্ত বাঁক। এখানে আমার প্রতিটি নির্বাক ধ্বনি—আমার প্রতিটি দৃষ্টিভ্রম আমাকে ঘুমের দরজায় স্বাগত জানায়। এই ঘুম ক্রমেই পবিত্র থেকে পবিত্র হয়ে ওঠে… যেদিন বরষা ছুঁয়ে জ্যোৎস্নায় ডুব দিবো ভেবেছিলাম; সেদিন থেকেই বিশুদ্ধ এক অসুখ আমাকে বাগিয়ে নিলো। বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। কাজের নামে সব অকাজে দিন চলে যায়। সূর্যের সাথে আলো পালালে নিত্যনিঃসঙ্গতা চারপাশের দেয়ালে সুড়সুড়ি দেয়…তীব্র কামকাতর হয়ে আলোকণার নিদ্রিত অন্ধকার জেগে ওঠে…তখন নিজেকে মেলে দেই তারাদের মৈথুন ক্রিয়ার অভ্যন্তরে। চেনা হরফের ডানায় বিজয় শীৎকার আমাকে এলোমেলো করে দেয়। নগ্ন বৃত্তান্তে মাথার কার্নিশে হেঁটে চলে তামাম দুনিয়া। মরুভূমির শূন্যতা—আফ্রিকার বর্ণবাদ—নিপীড়িত মানুষের অবয়বে পুঁজি বাজারে মুদ্রিত ছবি—সব জলছবি নিদ্রার বাড়িময় আমাকে খুঁজে বেড়ায়। অদৃশ্য সন্তানের মুখে চুমু খেয়ে তার প্রতিচ্ছবির বৈধতা দিতে চিৎকার করি; সময়-অসময়।
অস্থির ছবি কিংবা অসংখ্য মৃত্যু-মিছিলের বিবর্তিত স্কেচ। সময়ে লেখা কবিতা থেকে তুলনামূলক একটু দীর্ঘ। সময় নিয়ে নিজেকে পোড়ার জন্য কয়লাও হতে পারে! স্থির অথবা চূড়ান্ত অস্থির। যে অস্থিরতায় ডুবে ডুবে আবিষ্কার করা যায় আত্মপরিচয়। আবিষ্কারের নেশাটা মানুষের খুব প্রবল; হয়তো অন্য প্রাণীদেরও! আমিও আবিষ্কারের চেষ্টা করে গেছি শুরু থেকে শেষ—