“১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি ১ম খণ্ড” বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের। সবচেয়ে গর্বের। আমরা এক দিনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইনি। ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে চলেছে আমাদের প্রস্তুতি। একসময় আমরা ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সীমানা মেনে নিয়েছিলাম। এই মেনে নেয়া থেকেই আমরা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলাম পাকিস্তান আন্দোলনে। আমরা নিজেদের তখন আলাদা করে ভাবিনি। ফলে সেদিন ভৌগােলিক সীমারেখার ব্যবধানের কথা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তাই আমাদের মন ও মুখে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের সেই আবেগ এবং ভালােবাসার যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়নি। প্রতিনিয়ত অসম্মান, অমর্যাদা আর শােষণের ভেতরে থেকে বাঙালি খুব দ্রুতই ভুলগুলাে বুঝতে পারে। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই জাগ্রত হতে থাকে জাতীয়তাবােধ। আমাদের ভেতরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে স্বজাত্যবােধ। সেই বােধ বুকে নিয়েই নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছিষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর পেরিয়ে আমরা এগিয়ে আসি একাত্তরে। একাত্তর আমাদের জাগিয়ে দেয়। তারপর একসাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি আমাদের মহত্তম অর্জন-স্বাধীনতা। বাঙালির এই যে স্বাধীনতার দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসা, এই যে জেগে ওঠা- তা এক দিনের ফসল না। এ আমাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন।
ইতিহাসের নানা বাঁকের দিকে চোখ ফেরালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে-যুগে যুগে নানা জাতি-গােষ্ঠীর মানুষ এ দেশে এসেছে। তারা আমাদের শাসন করেছে। আমরা শােষিত হয়েছি, সহ্য করেছি- যখন তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, তখন প্রতিবাদ করেছি।
তারপর একসময় ঝাপিয়ে পড়েছি স্বাধীনতার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা চূড়ান্ত বিজয়রূপে আসে ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতার জন্য এই যে আমাদের বিপুল রক্তক্ষয়, সেই ইতিহাস নিয়ে এখনাে আমাদের অপূর্ণতা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের পরও রয়েছে আমাদের আফসােস।
স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, উনিশত পঁচাত্তর সালে রক্তাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে রাজনীতির পটপরিবর্তন করে রাষ্ট্রক্ষমতার কাছে ঘেঁষার সুযােগ পায়। তারপর দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে তারা জেঁকে বসে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি। নানাভাবে ছাপিয়ে রাখা হতে থাকে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা হতে থাকে। সেই চেষ্টা যে পুরােপুরি অসফল ছিল, তা বলার উপায় নেই। কারণ, সেই অন্ধকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলাও ছিল এক ধরনের অপরাধ। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযােদ্ধারা নানাভাবে অসম্মানিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চাকে কোনােভাবেই উৎসাহিত করা হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন, তারাও নিগৃহীত হবার ভয়ে পিছিয়ে থেকেছেন।
এমনভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে মানুষ কুণ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরােধীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসন পােক্ত করেছে। পতাকা উড়িয়ে ঘুরেছে পুরাে বাংলাদেশ। সেই অবস্থা থেকে দেশকে ঘুরিয়ে দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। যে প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল, সেই প্রজন্মই জেগে উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহী করে তােলে। তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মানিত করার নতুন লড়াইয়ে নামে। ভােটের রাজনীতিতে এই তরুণরা মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে রায় দেয়। সেই রায়ের ভিত্তিতে গঠিত সরকার জনদাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে শুরু করে মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত রায় দেন। অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত হয়। এর বিপরীতে আবার সম্মানিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযােদ্ধারা। কিন্তু আফসােস তবুও শেষ হয়নি। বেদনা তবুও শেষ হয়নি। কারণ, আজও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণতা পায়নি। | জাতীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হলেও এখনাে পর্যন্ত জেলাশহর, উপজেলা এবং প্রান্তিকের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের লিপিবদ্ধ হয়নি।
একটি ঘােষণায় শুরু হয়নি, যুদ্ধস্মৃতিতে সেদিকটিও স্পষ্ট। ৭ই মার্চের ভাষণই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়, সেই সত্যেরও উদাহরণ যুদ্ধস্মৃতি।
মুক্তিযােদ্ধাদের কথামালা টুকে রাখার দায়িত্ব নিয়ে অনুলিখন করেছেন মুক্তিযােদ্ধা সাইফুল ইসলাম। ভ, ইয়ান যে লিপিকারের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, মলাটবদ্ধ এই ১০টি লেখার সেই লিপিকার সাইফুল ইসলাম দীর্ঘ সময় নিয়ে, অসীম ধৈর্যে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাইফুল ইসলাম নিজে সাহিত্যিক। ছড়াকার হিসেবে রয়েছে খ্যাতি। এ ছাড়া অমানিশা ও রক্তজবা, বখতিয়ার খিলজি, উনিশ মে, দোম আন্তোনি’র মতাে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার কৃতিত্বও তার ঝুলিতে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে এখন অবসর জীবনে ব্যস্ত সার্বক্ষণিক লেখক হিসেবে। একাত্তর সালে দেশকে মুক্ত করতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। যুদ্ধ শেষে মুক্ত স্বাধীন দেশে- স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা তাকে করে তুলেছিল সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতির তাত্ত্বিক বিষয়গুলােকে সহজ করে উপস্থাপন করার কৌশল তাকে সহকর্মীদের মাঝেও দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। বর্তমানে সব ছেড়ে শুধু লেখালেখিটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার পঠন-পাঠন এবং লেখার বিষয় ইতিহাসকে ঘিরে। সেই পর্বের থেকে কিছু সময় নিয়ে তিনি লিপিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দায়িত্ব পালন ইতিহাসের পাঠকে সংরক্ষণের তাগিদ থেকে। তার এই ভূমিকা শুধু ধন্যবাদ দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না।