শিবনাথ শাস্ত্রী যাকে বলেছেন বঙ্গের নবযুগ পরে যার নাম হয় ‘বেঙ্গল রেনেসাঁস’ তার উপর যথেষ্ট গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমি আরও একশ বছর উজানে নৌকাটিকে নিয়ে যেতে চেয়েছি। প্রাক-রামমােহন-কালের ‘সেইতর সময়’ গভীর তমসাচ্ছন্ন।
ঊনবিংশ-শতক সাদায়-কালােয় মেশানাে। একদিকে বেড়ালের বিয়ে-বুলবুল-বাবু কালচার, অপরদিকে রামমােহন থেকে রবীন্দ্রনাথের অতন্দ্র সাধনার আশীর্বাদ। তুলনায় বক্ষ্যমান ঐতিহাসিক উপন্যাসের ‘সেইতর সময়, অষ্টাদশ শতাব্দী, নীরব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রাবণের অমারাত্রি!
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল অথবা রামপ্রসাদের কালীকীর্তন সমকালীন গৌড়জনের সঙ্গে সম্পর্কবিমুক্ত। সতীদাহ প্রথাটাকে তখনাে কারও আপত্তিকর বলে মনে হয়নি, বিধবাবিবাহ অলীক দিবাস্বপ্ন, কুলীন পাত্রের ধর্মপত্নীর সংখ্যা প্রকাশ করা হতাে কুড়ি’র এককে! স্ত্রীশিক্ষা ও বৈধব্যযােগে বাগর্থের মতাে সম্পৃক্ত।
কিন্তু এমনটা তাে হবার কথা নয়। বিবর্তনের একটি ফরুধারা যে থাকতেই হবে। লােকচক্ষুর অন্তরালে কেউ না-কেউ নদীয়ার সেই প্রেমানন্দে পাগল বিদ্রোহী পণ্ডিতের পর্ণকুটীর থেকে হােমাগ্নি শিখাটি নিশ্চয় পৌঁছে দিয়েছিলেন রাধানগরের রাজপ্রাসাদে-জ্ঞানগরিমার দার্চে সমুন্নতশির নবীন ঋত্বিকের হাতে। উনবিংশ শতাব্দীর সূর্যোদয় যখন প্রত্যক্ষ সত্য, তখন কেউ-না-কেউ নিশ্চয় গােপনে করে গেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর অমানিশায় ‘রাত্রির তপস্যা। বুড়াে ইতিহাস বেমালুম সে-কথা ভুলে গেছে। এই উপন্যাসে সেই ‘মিসিং লিংক’ টিকে খুঁজে বার করার চেষ্টা।
না! রূপমঞ্জরী’র নায়ক ‘সময়’ নয়। কারণ গােটা অষ্টাদশ শতাব্দীব্যাপী মহাকাল এই গৌড়দেশে বড় একদেশদর্শী। শতাব্দীর শুরু থেকে দক্ষিণাঞ্চলে বােম্বেটেদের অত্যাচার, তারপরেই বর্গীর হাঙ্গামা, পলাশীপ্রান্তরে যৌথ বিশ্বাসঘাতকতা! এরপর মীরজাফর-রেজা খাঁ-দেবীলালের নির্মম শােষণ; যার অনিবার্য ফল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
‘সুসময়’ আদৌ এল না গােটা সেই-তর’ শতাব্দীতে সবটাই ‘দুঃসময়। তাই আমার কাহিনির নায়ক সেই নিঃসঙ্গ ক্লান্ত বিহঙ্গটি যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছিল ‘আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ- অঙ্গন। নায়িকা: পরবর্তী জমানার ঐ ক্লান্ত বিহঙ্গের আত্মজা!
দুইজন ঐতিহাসিক মহিলা- হটু বিদ্যালঙ্কার আর হটি বিদ্যালঙ্কারের জীবনীর উপাদান দিয়ে গড়া আমার কল্পনাসৃষ্ট মানসকন্যা -তথা-জননী: ‘রূপমঞ্জরী।